বাংলাদেশের প্রথম নারী বন্যপ্রাণীবিদ

প্রফেসর ড. নূরজাহান সরকার, বাংলাদেশের প্রথম নারী বন্যপ্রাণীবিদ।

১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলাতে জন্ম নেয়া মেয়েটি অন্য আর দশটি মেয়ের মতো ছিলো না। তাঁর পৈতৃক নিবাস নলছিটির ভেরনবাড়িয়া গ্রামের পঞ্চায়েত বাড়িতে। প্রচণ্ড মেধাবী আর লেখাপড়ায় প্রবল আগ্রহ। ছিলেন মেধাবী, পড়েছেন বৃত্তির টাকায়, শ্রেণিতে কখনো দ্বিতীয় না হওয়া মেয়েটি তৎকালীন সমাজের ধরাবাঁধা নিয়ম ও সঙ্কীর্ণতাকে পাড়ি দিয়ে সময়ের স্রোতে নিজেকে গড়ে তুলেছেন প্রফেসর ড. নূরজাহান সরকার, বাংলাদেশের প্রথম নারী বন্যপ্রাণীবিদ।

তাঁর বেড়ে ওঠার সময়কালে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে সমাজের নিয়মে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তিনি ব্রত নিলেন, লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন। আর এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি সহযোগিতা পেলেন তাঁর মায়ের। তাঁর বাবার কাছে মায়ের একটাই অনুরোধ ছিল-এম.এস.সির আগে যেন ছোট্ট নূরজাহানের বিয়ে দেয়া না হয়।

প্রবল মনোবলের অধিকারী নূরজাহান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন বন্যপ্রাণী বিষয়েই। কিন্তু বাঁধ সেধেছিল সমাজের সেই ধরাবাঁধা নিয়ম-নীতি, নারী হয়ে বন্যপ্রাণী বিষয়ে লেখাপড়া করবে, বনে-জঙ্গলে ঘুরবে, পাহাড় নদী ডিঙ্গোবে ইত্যাদি। এমন পস্থিতিতে নূরজাহান সরকার শরণাপন্ন হয়েছিলেন বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী বিদ্যারজনক প্রফেসর ড. কাজী জাকের হোসেনের। দিনের পর দিন তাঁর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন, কারণ স্যারও বলেছিলেন- ”তুমি অন্য কোনো বিষয়ে পড়ো, মেয়ে হিসেবে এই বিষয়টি তোমার জন্য কঠিন হবে।”

তবে নূরজাহান সরকারের জবাব ছিলো- “আমি তো মানুষ। মানুষ হিসেবে আমি কেন পারবো না, যদি অন্যরা পারে।” এমন উত্তরে মহাজ্ঞানী জাকের হোসেন স্যার ভুল করলেন না সঠিক মানুষ চিনতে। বললেন, ”তুমি একটা সাদা কাগজে দুই পৃষ্ঠাতে লিখবে কেন তুমি বন্যপ্রাণী বিষয়ে পড়বে। ইংরেজিতে লিখবে, দুই পৃষ্ঠার কমও না, বেশিও না।”

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্যপ্রাণীবিদ ড. নূরজাহান সরকার (ডানে প্রথম)

এরপর বন্যপ্রাণী বিষয়ে নিজের আগ্রহ, ইচ্ছে ও ভালোবাসা কথা উজাড় করে লিখছিলেন নূরজাহান সরকার। তা দেখে স্যার প্রশ্ন করলেন, ”বনজঙ্গলে ঘুরতে পারবে? মাসের পর মাস কাটাতে পারবে?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ছোটবেলা থেকেই ওই বনের মায়ায়, পাখ-পাখালির গানে, প্রকৃতির আদরে বেড়ে ওঠা। আপনজনের কাছে থাকতে সমস্যা কোথায়?

শুরু হলো নূরজাহান সরকারের পথচলা। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী রমনাপার্ক আর বলধা গার্ডেন। সাদা এ্যাপ্রোন, মাথায় হ্যাট পরে যাত্রা শুরু। এরপর সুন্দরবন থেকে বান্দরবান, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন পূর্ণ উদ্যোমে। প্রকৃতি তাঁকে যেন নিজ কন্যারূপেই গ্রহণ করেছে। বন্যপ্রাণী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে। গণমানুষের কাছ থেকেও পেয়েছেন অফুরন্ত ভালোবাসা। উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পাঁড়ি জমান ফ্রান্সে। সেখানেও তাঁর কাজের কৃতিত্বে মুগ্ধ সবাই। তাঁর কাজের খবর প্রকাশ পেত ফ্রান্সের দৈনিক পত্রিকায়। এভাবেই একটু একটু করেই নিজেকে গড়েছেন প্রফেসর ড. নূরজাহান সরকার।

তবে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে প্রাণীবিদ্যায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ১৯৭৪ সালে ফ্রান্সের বোর্দো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন ’বঙ্গবন্ধু এওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন-২০১৫’সহ একাধিক সম্মাননা। হাজারো শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়েছেন জ্ঞানের আলো। বন্যপ্রাণীর নিয়ে করেছেন বহু গবেষণা।

জাতীয়-আন্তর্জাতিক জার্নালে রয়েছে সেসব গবেষণাপত্র। রয়েছে একাধিক বন্যপ্রাণী বিষয়ক বই। প্রাণ প্রকৃতিকে ভালোবেসে সংরক্ষণের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তাই সুযোগ পেলেই ছুটে যান বন-জঙ্গলে। লিখে যাচ্ছেন বন্যপ্রাণী বিষয়ে, যা সংরক্ষণ সচেতনতায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাঁর মতে, ”মেয়েদের আর মায়েদের মধ্যে থাকে এক অপূর্ব প্রাণশক্তি, যা সব অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারে।”

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্যপ্রাণীবিদ ড. নূরজাহান সরকার (মাঝে)

সময় আপন নিয়মে চলে, সময়ের সাথে বদলে যায় অনেক কিছু। নারীরা আজ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু আজও কী যোগ্য সম্মান পাচ্ছেনা তাঁরা? নারীরা পুরুষের সহযাত্রী, অনুগামী নয় এটা কী ভাবতে শুরু করেছে আমাদের সমাজব্যবস্থা? এখনো দেখা যায় মাঠ পর্যায়ের কাজগুলো ছেলেদের, আর ল্যাবরেটরীর কাজগুলো মেয়েদের। ব্যাপারটা শুনলে মনে হয় মেয়েরা ঘরের কাজ করবে আর ছেলেরা বাইরের বৈজ্ঞানিক রূপ! তবে হ্যাঁ আমাদের দেশসহ বিশ্বব্যাপী নারীদের জন্য নিরাপত্তাজনিত আতঙ্ক বা প্রতিবদ্ধকতা রয়েছে। তাই বলে তো নারীদের ঘরের গন্ডিতে আটকে থাকার সুযোগ নেই। পৃথিবীকে দেখার প্রকৃতির পরশ নেয়ার অধিকার নারীরও আছে। প্রকৃতি কোন ভেদাভেদ করে না তার সন্তানদের জন্য।

সকলের নিশ্চয় মনে আছে, শুধুমাত্র নারী বলে এম.ডি পরীক্ষা ১ নম্বরের জন্য মৌখিক পরীক্ষাতে ফেল করানো হয়েছিল বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়কে; কারণ তৎকালীন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. আর.সি চন্দ্র মানতে পারেননি কোনো নারী রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে চিকিৎসক হবেন। কিন্তু অদম্য সাহস আর মনোবলে কাদম্বিনী জয় করেছিলেন সব। তিনি এবং চন্দ্রমুখী বসু ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা গ্যাজুয়েট।

সমাজের সকল সঙ্কীর্ণতাকে উপেক্ষা করে কোলকাতার রাস্তায় টাট্টুঘোড়ার গাড়িতে দূরন্ত গতিতে ছুটে মানুষের সেবা করে আর গোড়ামিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, বাংলায় নারীশিক্ষা জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গিয়েছেন ডা. গাঙ্গুলী। যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হর্তাকর্তারা তাঁকে চিকিৎসক হওয়ার পথে বাঁধা তৈরি করেছিলো আজ সেই পুরুষেরাই তাঁকে নিয়ে বই লিখেন, তাঁর বায়োপিক বানায়, তাঁকে আদর্শ মানেন। হাজারো নারী মেডিকেল কলেজে পড়তে যায়, চিকিৎসা সেবার মহান ব্রত নিয়ে… এই সবটাই শুরু হয়েছে ওই মহিয়সী দুই নারীর হাত ধরে।

এভাবেই বাংলাদেশে এখন জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণীবিদ্যা বিভাগসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে, বনবিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের গবেষণা, শিক্ষা প্রদান, মেধা, শ্রম, কর্ম, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এ দেশের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় রেখে যাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁরা স্ব-মহিমায় প্রজ্বলিত করবে নিজেদের আর সেই আলো ছড়িয়ে পড়বে পুরো পৃথিবীতে। সকল নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।