প্রিয় এনা, ভালো থেকো

ছবি: প্যালাসেস ফিশ ঈগল বা কুড়া ঈগল। এটির নাম এনা। ছবিটি ধারণ করেন- জুগদারনামজিল নেরগুই।

গত ৩রা ডিসেম্বর মাঝরাতে আমার গবেষক বন্ধু অধ্যাপক জোনাস ওয়ালডেনস্টোর্ম সুইডেন থেকে মুঠোফোনে জানালেন এনার চলাচল এক জায়গায় থেমে আছে। রাতেই আমরা এনাকে খোঁজা শুরু করলাম। ঢাকা শহর থেকে ভারতের বিহার রাজ্যেও লাকিসারাই নামের এক গ্রামে এনাকে খুঁজতে শুরু করি। ওই এলাকায় এনার অবস্থান বেশ কয়েকদিন ধরে।

২৫ নভেম্বর থেকে ওই একটি জায়গায় থেকে এনা আর নড়েনি। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। পূর্বের বেশ কয়েকটি ঘটনার অভিজ্ঞতা বলে এ ধরনের অবস্থান নিশ্চয় ভালো লক্ষণ নয়। রাতেই ভারতীয় শিকারি পাখি বিশেষজ্ঞ কিরান শ্রিভাসটাভাকে একটি বার্তা পাঠালাম পাখিটি নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিহারে যোগাযোগ করলেন কিরান। প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত কোন হদিস পেলাম না। খুব ভোরে মোবাইলে কিরানের বার্তা পেলাম। মৃত পাখিটির সব তথ্য পাওয়া গেছে।

৪ ডিসেম্বর সাত সকালে এরকম একটি বার্তায় মনটা খাবার হয়ে গেল। এনা আমাদের সবার প্রিয় পাখি। এটি একটি মেয়ে পালাসের কুড়া ঈগল। এ বছরের ২৫ আগষ্ট পশ্চিম মঙ্গোলিয়ার আইরাগ লেক থেকে পাখিটির পিঠে একটি জিপিএসজিএসএম ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। মূলত বৈজ্ঞানিক উপায়ে পাখিটির পরিযায়ন রহস্য বের করাই এর মূল উদ্দেশ্য। যন্ত্র বসানোর দিন থেকে পাখিটি বেশ ভালো ভাবেই চলছিল। মঙ্গোলিয়ায় এই গবেষণার কাজটি করেন আমার সহকর্মী গবেষক বন্ধু বাটমুখ দাভাসুরেন। ওই লেক ও আশেপাশে এলাকা থেকে নিয়মত পাখিটি মাছ ধরে খাচ্ছিল।

১৯ মে সেপ্টম্বর পাখিটি চীনের সাংরি লা হয়ে হিমালয় পাড়ি দেয়। এরপর ৯ অক্টোম্বর পর্যন্ত ঈগলটি ভারতের মনিপুর এলাকায় ছিল। হঠাৎ করেই এনা বাংলাদেশের সিলেটে চলে আসলো ১০ অক্টোম্বর। তখন আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। মনে হয়েছিল হাওর পাড়ের কোন এলাকায় এনা বাসা বাঁধবে। কিন্তু পাখিটি আবার চলে গেল ভারতের বিহারে।

২৪ নভেম্বর পর্যন্ত এনা বেশ ভালই ছিল। লাকিসারাই এর পাশ দিয়ে কিউল নদী বয়ে গেছে। এই নদী ও আশেপাশের এলাকা থেকে এনা মাছ ধরে খেত। জোড় বেঁধে এনা সংসারও শুরু করেছিল। ২৫শে নভেম্বর এনা একটি বৈদ্যুতিক তারের সাথে সংঘর্ষ হয় এনার। সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। তার মৃতদেহটি একটি ধানক্ষেতে পড়ে ছিল।

একজন কৃষক তার পায়ে রিং আর পিঠে সাটেলাইট যন্ত্র দেখে স্থানীয় পুলিশকে খবর দেয়। এরপর পুলিশ বিহার বনবিভাগের সহায়তায় উদ্ধার করে ট্যাগটি। এনার শরীরে পড়ানো ট্যাগটি আমরা ফিরে পেয়েছি কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি প্রিয় এনাকে। এনা বেঁচে থাকলে এ বছর তার সংসারে বাচ্চা আসতো। তার পুরো জীবনচক্র আমরা জানতে পারতাম। এনাকে হারিয়ে সত্যিই আমরা দিশেহারা।

এনা নামের এই ঈগলটি একটি পরিযায়ী ঈগল। পাখিটির ইংরেজি নাম প্যালাসেস ফিস ঈগল। গ্রীষ্মের পুরো সময়টা এরা তিব্বত আর মঙ্গোলিয়ার লেকগুলোতে কাটায়। শীত নামার সাথে সাথেই এ জাতের ঈগল চলে আসে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে। কিছু পাখি যায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। মূলত পাখিটি মিঠাপনির জলাশয়ে বাস করে এরা। এদেশে পাখিটি প্রজননকাল সম্পন্ন করে। আমাদের হাওড়ের প্রধান ঈগল হলো কুড়া ঈগল।

পালাসের কুড়া ঈগলের জন্য তিব্বতের লেক যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বাংলাদেশের হাওর। পুরো অঞ্চলটি ভালো না থাকলে পাখিটির বড় বিপদ। দিন দিন এ পাখিটির সংখ্যা কমছে। বিশ্বব্যাপী পাখিটি এখন স্থান পেয়েছে বিপন্ন তালিকায়। পালাসের কুড়া ঈগল নিয়ে চলছে আমাদের গবেষণা। এনার মতো হাজার হাজার পাখি বৈদ্যুতিক তারের সংঘর্ষে মারা যায়। হয়তো সেসব খবর আমাদের জানা নেই। পাখি চলাচলে এখন অরক্ষিত বৈদ্যুতিক তার একটি বড় হুমকি। আমরা জানি এনার পরিবার এখন ভালো নেই। কঠিন এই পৃথিবী ছেড়ে ওপারে এনা নিশ্চয় ভালো থাকবে।

লেখক: বন্যপ্রাণি গবেষক, বাংলাদেশ।