
(ঢাকা, বাংলাদেশ ): বিড়াল প্রজাতির ডোরাকাটা বাঘ শুধু বনজঙ্গলের রাজা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্যের প্রতীকও বটে। কোটি বছরের বিবর্তনের পর আজ এই মহিমাময় প্রাণী চরম সংকটে। একসময় এশিয়া জুড়ে শাসন করা বাঘ এখন সংখ্যায় কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার হাজারেরও নিচে। মানুষের দখল, শিকার ও বন উজাড়ের কবলে বাঘের টিকে থাকার লড়াই যেন প্রতিদিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, আজ থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ডাইনোসর যুগে বাঘজাতীয় মাংসাশী প্রাণীর উৎপত্তি হয়। গন্ধগোকূল সদৃশ প্রাণী থেকে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বাঘের সৃষ্টি হয়েছে। বাঘের অনন্য পরিচয় হলো তাদের স্বতন্ত্র ডোরাকাটা দাগ, যা বিড়াল গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে তাদের আলাদা করে তুলে। বাঘ (Panthera tigris/প্যানথেরা টাইগ্রিস) বিড়াল গোত্রের বৃহত্তম প্রাণী।
ইতোমধ্যে বাঘের তিনটি উপপ্রজাতি—কাস্পিয়ান বাঘ, জাভান বাঘ ও বালির বাঘ—বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে বেঙ্গল টাইগার (বাংলা বাঘ), ইন্দোচীন বাঘ, মালয় বাঘ, সুমাত্রীয় বাঘ, সাইবেরীয় বাঘ এবং দক্ষিণচীন বাঘ—এই ছয়টি উপপ্রজাতি টিকে আছে। তবে বাঘ সমৃদ্ধ পৃথিবীর ১৩টি দেশের মধ্যে কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম থেকে বনের বাঘ বিলুপ্ত হয়েছে।
বাঘের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য নৃশংসভাবে বেআইনিভাবে হত্যা করা হয়, যা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষধ ও সৌখিন সামগ্রী তৈরির জন্য চড়া দামে বিক্রি করা হয়। অপরিকল্পিত বন উজাড়, চোরাশিকার, অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্য এবং মানুষসৃষ্ট প্রভাবের কারণে বিগত ১০০ বছরে বাঘের সংখ্যা ও বিস্তৃতি ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
সংকট কাটাতে ২০১০ সালে রাশিয়ায় বাঘ সমৃদ্ধ দেশগুলোর সরকার প্রধানদের নিয়ে প্রথম বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ইতোমধ্যে ভারত, নেপাল, রাশিয়া এবং আংশিকভাবে ভুটান এই লক্ষ্য অর্জন করেছে। কাজাখস্তান ও চীন সীমান্তে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু মালয়েশিয়ায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বে মোট বাঘের সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের মতো, যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা আড়াই হাজার।
সুন্দরবনের বাঘ
বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগার সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের বাঘের খাবারের ৭৪ শতাংশ আসে চিত্রা হরিণ থেকে এবং তারা প্রায় এক কিলোমিটার পথ সাঁতরে যেতে পারে। লবণসমৃদ্ধ প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য সুন্দরবনের বাঘের আকার তুলনামূলকভাবে ছোট হয়েছে। এসব সক্ষমতা বাঘের অন্য পাঁচটি উপপ্রজাতি থেকে আলাদা করে।
২০১৮ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪ এবং ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১২৫।
দেশের দুইটি চিড়িয়াখানা ও দুইটি সাফারি পার্কে বর্তমানে ৩৭টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় ১২টি, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ১২টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুরে ৯টি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, ডুলাহাজারায় ৪টি বাঘ রয়েছে।
বাঘের ডোরাকাটা
বাঘের মুখ ও শরীরের স্বতন্ত্র ডোরাকাটা বিন্যাস বাঘভেদে আলাদা। এই বৈশিষ্ট্য শিকার থেকে নিজেদের আড়াল করতে এবং প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে। ক্যামেরা ট্র্যাপিং বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই ডোরাকাটা প্যাটার্নের সাহায্যে বাঘের গতিবিধি ট্র্যাক করে বাঘশুমারি করা হয়।
আকার ও আবাস
বিড়াল গোত্রের প্রাণীর মধ্যে বাঘ সবচেয়ে বড়। একেকটি বাঘের ওজন প্রায় ৩০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। সাইবেরিয়ান টাইগার ও বেঙ্গল টাইগার আকারে সবচেয়ে বড়।
বাঘ প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশিয়ার বনাঞ্চলে বসবাস করে। এছাড়া রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের মতো ঠান্ডা জলবায়ুতেও তাদের দেখা মেলে। বর্তমানে থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, চীন ও রাশিয়াসহ ১০টি দেশে বন্য বাঘ রয়েছে।
বাঘের ডাক
বাঘ ক্রমাগত চিৎকার করতে পারে না। স্বরযন্ত্রের ইলাস্টিক হাইয়েডের বিশেষ গঠনের কারণে তারা গর্জন করে। বাঘের ডাক তিন কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। তাদের ডাক অনেকটা “হালুম হালুম” শব্দের মতো শোনায়।
খাদ্যাভ্যাস
বাঘ মাংসাশী প্রাণী। তারা হরিণ, বন্য শূকর, বন্য গরু-মহিষ, বানর ইত্যাদি স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করে খায়। সুন্দরবনের বাঘ মাছ ও কুমিরও খেয়ে থাকে। এরা নিশাচর এবং গোধূলি ও ঊষালগ্নে শিকার করে। শিকারের সময় ঝোপের আড়ালে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে এবং ১৫-২০ মিটারের মধ্যে শিকার এলেই অতর্কিত আক্রমণ চালায়। শিকারকে থাবার আঘাতে ধরাশায়ী করার পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
প্রজনন
নভেম্বর থেকে এপ্রিল বাঘের প্রজননের উৎকৃষ্ট সময়। গর্ভকাল ১০৩-১০৫ দিন এবং প্রতি প্রজননে দুই থেকে পাঁচটি শাবক জন্ম দেয়। জন্মের প্রথম ১০-১২ দিন শাবকগুলো অন্ধ থাকে। ৩-৫ মাস বয়সে দুধ ছাড়ে এবং ১৮-২৪ মাসের মধ্যে শিকার শেখে। দুই বছর বয়সের পর পুরুষ বাঘ দূরে ছড়িয়ে পড়ে, স্ত্রী বাঘ মায়ের টেরিটরির কাছাকাছি থাকে।
রোগবালাই
গবেষণায় পাওয়া গেছে, ক্যাপটিভ বাঘ মারা যাওয়ার প্রধান কারণ ভাইরাসজনিত রোগ এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ক্যানাইন ডিস্টেম্পার। বন্য বাঘ ফেলাইন ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হয়। এছাড়া ফেলাইন ক্লেমাইডোফিলিয়া, ডাইরোফাইলেরিয়া, ফেলাইন ক্যালসিভাইরাস, ফেলাইন করোনাভাইরাস, ফেলাইন লিউকেমিয়া, ফেলাইন হারপিস ভাইরাস, ফেলাইন পারভোভাইরাস, যক্ষ্মা, জলাতঙ্ক এবং সারকপটিক ম্যাঞ্জ উল্লেখযোগ্য রোগ। সুন্দরবনের বাঘের জন্য ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি।
মানুষ, গৃহপালিত প্রাণী এবং বাঘের সংঘর্ষ শত শত বছর ধরে চলছে। শিকার প্রাণী যেমন হরিণ, গরু, ছাগল ও বন্য শূকর থেকে বাঘ কিছু রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। তবে এ নিয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট গবেষণা হয়নি।
বিশ্ব বাঘ দিবস
২০১০ সালে রাশিয়ায় বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সরকার প্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণ জোরদারের লক্ষ্যে একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য: ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরনের সমৃদ্ধি’।