মব কিলিংয়ে মেছো বিড়ালের নির্মম পরিণতি!

মব কিলিংয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখারীতে হত্যার শিকার মেছো বিড়াল। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

(ঢাকা, বাংলাদেশ): সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে প্রায়ই ‘বাঘ আতঙ্ক’ চোখে পড়ে। আর পোষ্টগুলো কিংবা সংবাদে বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই দেখা যায় ‘ভয়ঙ্কর প্রাণী’ হত্যা করে ফেলেছে মানুষ; নয়তো বন্দি করেছে। অনেক পোস্টে দেখা যায়- গ্রামের কোন হাঁস-মুরগির খামারে ফাঁদ পেতে জীবিত ধরা হয়েছে ’বাঘ’। কিন্তু ’বাঘ আতঙ্কে’ যে প্রাণীটিকে মেরে ফেলে হচ্ছে বাংলাদেশে সেটি আসলে কোন ভয়ঙ্কর প্রাণী নয়, তবে তা নিরীহ মেছো বিড়াল

সম্প্রতি হিউম্যান ডাইমেনশনস অব ওয়াইল্ডলাইফ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ফিশিং ক্যাট বা মেছো বিড়াল হত্যার মূল কারণ অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং কুসংষ্কার, ভয় এবং সামাজিক সমস্যা। জাপান এবং বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল গবেষণাটি পরিচালিত করে।

মেছো বিড়াল মূলত দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। এটি একটি মাঝারি আকারের বিড়াল জাতীয় প্রাণী, যা সাধারণত জলাভূমি, পুকুর, নদী বা সোডে বসবাস করে এবং মাছ শিকারের জন্য পরিচিত। মেছো বিড়াল সাধারণত গভীর পানিতে পা ডুবিয়ে মাছ শিকার করে এবং তাদের পায়ের মধ্যে বিশাল আঁকড়ে ধরা শিকার ক্ষমতা থাকে। তাদের দেহের আকার এবং শক্তি তাদের পানির মধ্যে দ্রুত চলাচল করতে সাহায্য করে।

হিমালয় অঞ্চলের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে দেখা যায় মেছো বিড়াল। প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএন’র লাল তালিকায় ’বিপন্ন’ প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে মেছো বিড়াল।

মাগুরার শ্রীপুরে ধাওয়া করে মেছো বিড়াল হত্যার চেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত

গবেষণায়পত্রে বলা হয়, মেছো বিড়াল, সোনালী শিয়াল, এবং জঙ্গলের বিড়ালের নিয়ে বাংলাদেশের হাকালুকি হাওর অঞ্চলে বসবাসরত বাসিন্দাদের মধ্যে ২৪৪টি পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়। এতে ৮৮% মানুষ মেছো বিড়ালের মাধ্যমে পোল্ট্রি বা হাঁস-মুরগি হারানোর ঘটনা তেমন গুরুতর মনে না করলেও, ৮৪% মানুষ মনে করেন- এই বিড়ালগুলো মানুষের ওপর আক্রমণ করে। এই ভয়, এবং ভুল ধারণার কারণে মেছো বিড়ালকে এক ধরনের ’বাঘ’ হিসেবে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে। ফলে বাসস্থান হারানোসহ মানুষের শত্রুতার কারণে বাংলাদেশে এই প্রজাতিটির বেঁচে থাকা এখন হুমকির মুখে।

গবেষণায় জানা গেছে, গ্রামের মানুষ মেছো বিড়লকে বাঘ হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করে তাদের শরীরে ডোরাকাটা দাগযুক্ত থাকার কারণে। এই ভুল পরিচয় মেছো বিড়াল হত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ গ্রামবাসীরা মনে করেন, এই বিড়ালটি মানুষের জন্য বড় ধরনের বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণাপত্রের সহলেখক ড. মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ‘গ্রাম-গঞ্জের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে, মেছো বিড়াল এক ধরনের বাঘ। যদিও এই প্রাণীটি মানুষের ওপর আক্রমণ করার কোনো প্রমাণ নেই, তবুও এই ভয় মানুষের মনে গভীরভাবে রয়ে গেছে। আর এই কারণে মেছো বিড়াল হত্যার শিকার হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত মানুষ এটিকে একটি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে দেখে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০% উত্তরদাতা মনে করেন, মেছো বিড়াল হত্যার মাধ্যমে তাদের প্রতিবেশিদের উপকার হয়, এবং অনেকেই মনে করেন, যদি তারা এমন বিড়াল দেখে তবে সামাজিকভাবে হত্যায় অংশগ্রহণ করা উচিত।’

মেছো বিড়াল। ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক সংকট

গবেষণাটি মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণ ধারণা চ্যালেঞ্জ করেছে, যেখানে মূলত আর্থিক ক্ষতির কথা বলা হয়। যদিও মেছো বিড়াল কখনও কখনও পোল্ট্রি- যেমন: হাঁস-মুরগি ইত্যাদি শিকার করে থাকে, তবুও ১০.৬% গ্রামবাসী এই ক্ষতিকে গুরুতর মনে করেন।

গবেষকরা দ্যা থিওরি অব প্ল্যানার্স (টিবিপি) ব্যবহার করে দেখেছেন, মেছো বিড়াল হত্যার পেছনে অর্থনৈতিক ক্ষতির তুলনায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং ব্যক্তিগত মনোভাব।

সামাজিক প্রেক্ষাপট

গবেষণার আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো – যখন কোন গ্রামে একটি মেছো বিড়ালকে দেখা যায়, তখন প্রতিবেশিরা একত্রিত হয়ে সেটিকে হত্যা করে। এই ধরনের দলগত কাজ মানুষের মনে এটি মেরে ফেলাকে ‘সঠিক’ কাজ হিসেবে গড়ে তোলে। আর কেউ প্রশ্নও তোলে না কারণ এটি সমাজে সার্বজনীনভাবে গৃহীত অভ্যাস হয়ে উঠেছে। এই আচরণ অন্যান্য শিকারি প্রাণীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয় তার তুলনায় একেবারেই আলাদা। যদিও জঙ্গলি বিড়াল এবং সোনালী শিয়ালও পোল্ট্রি শিকার করে, তবে তাদের প্রতি মেছো বিড়ালের মতো বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় না। গবেষণায় প্রস্তাব করা হয়েছে, মেছো বিড়ালের প্রতি এই কলঙ্ক বিশেষ এবং সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী কল্পনার ফলস্বরূপ।

উদ্ধার হওয়া মেছো বিড়ালের ছানা। ফাইল ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার
সংরক্ষণ

গবেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি মেছো বিড়াল হত্যা করার এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা মোকাবেলা না করা হয়, তবে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। তারা কমিউনিটি-বেসড শিক্ষা প্রোগ্রাম, সামাজিক মনোভাব চ্যালেঞ্জ করা, স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে যুক্ত করাসহ বেশ কিছু মূল কৌশল প্রস্তাব করেছেন গবেষণাপত্রে। পাশপাশি সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম বিশেষ করে বন্যপ্রাণী আইন এবং তা প্রয়োগ শক্তিশালী করায় জোর দেওয়া হয়েছে।

গবেষক ড. আজিজ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ একাই এই সমস্যার সমাধান করবে না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা এবং সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে মানুষ মেছো বিড়াল সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারে।’

আন্তর্জাতিকভাবে মেছো বিড়াল সংরক্ষণে প্রতিবছর পহেলা ফেব্রুয়ারি পালিত হয় আন্তর্জাতিক মেছোবিড়াল দিবস। এ বছর প্রথমবারের মতো নানা আয়োজনে বিশ্ব মেছো বিড়াল দিবস-২০২৫ উদযাপন হচ্ছে বাংলাদেশে। দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘জনগণ যদি হয় সচেতন, মেছো বিড়াল হবে সংরক্ষণ।’