বাঘবর্ষ ২০২২: বাঘ রক্ষার এক যুগের হালচাল!

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বেঙ্গল টাইগার/বাংলার বাঘ। ছবি তুলেছেন: আদনান আজাদ আসিফ, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী।

২০১০ সাল, ১৩টি দেশ, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে একটি উদ্দেশ্য ঠিক করে যে পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করবে বন্য বাঘের সংখ্যা। ওই বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের পর বাংলাদেশসহ বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশ বাঘের  রক্ষায় গ্রহণ করে নানা পদক্ষেপ। ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। এই বছরের বাঘ দিবসটি বিশেষ, কারণ চাইনিজ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০২২ সাল হচ্ছে ইয়ার অব টাইগার অর্থাৎ বাঘবর্ষ। এ বাঘবর্ষকে কেন্দ্র করেই সেন্ট পিটার্সবার্গে নেয়া হয়েছিল ১২ বছরব্যাপী বাঘ বৃদ্ধির মহাপরিকল্পনা।

পৃথিবীর সবচেয়ে আইকনিক ও ডোরা কাটা প্রাণী টাইগার বা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ঠিক করা হয়েছিল তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের নেয়া পদক্ষেপ ও ফলাফল নিয়ে এই প্রতিবেদন।

এক যুগব্যাপী আগে নেয়া নানা পদক্ষেপের পর বিশ্বের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বেড়েছে বাঘ। এ নিয়ে চলতি বছরের ২১ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা- প্যানথেরা। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে সাত বছরে বিশ্বে বাঘ বৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশ। এর আগে ২০১০ সালে পৃথিবীতে বাঘ ছিল তিন হাজার ২০০টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার হাজার।

প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএন জানায়, দক্ষিণ এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাঘ। বিশেষ করে ভারত ও নেপালে। উত্তর-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে রাশিয়ায় বাঘের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল এবং চীনের সীমান্তে বাড়ছে বাঘ। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাঘের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এরই মধ্যে ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের মধ্যে তিনটি দেশে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাঘ। দেশগুলো হলো- কম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনাম। গত এক যুগে এই তিন দেশে বাঘ সংরক্ষণ এবং বৃদ্ধিতে ছিল না কোন অগ্রগতিও।

আইইউসিএন’র তথ্যমতে, সাড়ে চার হাজার বাঘের গড় হিসেবে এশিয়ায় বন্য বাঘ রয়েছে তিন হাজার ৭২৬টি থেকে পাঁচ হাজার ৫৭৮টি। এই বাঘের মধ্যে গড়ে তিন হাজার ১৪০টি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ। আর বৈশ্বিক বাঘের জনসংখ্যার প্রায় ৭৬ শতাংশ রয়েছে ভারত ও নেপালে।

গাছের ডালে বাংলার বাঘ/বেঙ্গল টাইগার। ছবি: ফরিদী নুমান, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোচিত্রী।

বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে ভারত, নেপাল, রাশিয়া এবং আংশিকভাবে সক্ষম হয়েছে ভুটান। ২০১৮ সালের জরিপে এই চারটি দেশে বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি বেশি না হলেও এই হার আট শতাংশ। বিভিন্ন দেশের বাঘ সমীক্ষার তথ্যমতে, ২০১৫ সালের জরিপে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। তবে ২০১৮ সালের সবশেষ জরিপের তথ্যমতে আটটি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১১৪টি বাঘ। আর  ভারতের ৫২টি টাইগার রিজার্ভে বাঘের সংখ্যা দুই হাজার ৯৭৬টি, যা এক যুগ আগে ছিল প্রায় ১২-১৩শটি। দেশটিতে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে- বালিনীজ টাইগার, জাভানীজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার। আর টিকে আছে পাঁচটি উপ-প্রজাতি। এগুলো হলো- বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার।

ডাব্লিউডাব্লিউএফ’র তথ্যমতে, সবশেষ জরিপ অনুযায়ী গড়ে ভুটানে ১২৪টি, নেপালে ৩৫৫টি, রাশিয়া ও চীনে ৫৮০টি, ইন্দোনেশিয়ায় ৬০০টি, মালয়েশিয়ায় ১৫০টি, থাইল্যান্ডে ১৫০টি এবং মিয়ানমারে রয়েছে ২২টি বাঘ।

বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘ বিচরণকারী দেশের অর্ধেকের বেশি দেশে প্রাণীটির সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার প্রবণতা চলমান। গত কয়েক দশক ধরেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর মধ্যেও অন্যতম বাঘ। তাই শতাংশের হিসেবে বেশ খানিকটা বাড়লেও এখনও সেই ঝুঁকি কাটেনি বলে বলছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষকরা। তবে কয়েক বছর ধরে বিশ্বে বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ক সচেতনতা বেড়েছে বলছেন তারা। যদি তা অব্যাহত থাকে তাহলে দ্রুতই বিলুপ্তির ঝুঁকি থেকে প্রাণীটিকে রক্ষা করা যাবে বলছেন প্রাণীবিদরা।

বাংলাদেশের বাঘ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রধান প্রফেসর মনিরুল হাসান খান বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন দেশে বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। এর আগের ১০০ বছর বাঘের সংখ্যা কমেছে। ২০১০ সালে ছিল ৩২শ, এখন ৪০.৬ শতাংশ বেড়েছে। সে হিসেবে দ্বিগুণ না হলেও এটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং অবশ্যই তা ধরে রাখতে হবে। ইতিমধ্যে ১৩টি দেশের মধ্যে ৩টি দেশে বিলুপ্ত হয়েছে। মালয়েশিয়াতেও ৮০ শতাংশ কমেছে। ভারত, নেপাল, ভূটান এমনকি চায়নাতেও বেড়েছে বাঘ।”

“বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আট শতাংশ বেড়েছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশে এখনো বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। সুন্দরবনে এখনও ২০০ বাঘ বসবাসের সুযোগ আছে। তাই সংখ্যা বৃদ্ধির পদক্ষেপগুলোতে আরো জোর দিতে হবে,” যোগ করেন মনিরুল হাসান খান।

নেপালের বারদিয়া ন্যাশানাল পার্কে বন্য বাঘ। ছবি: মঞ্জু মাহাতারা, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী, নেপাল।

বাঘ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. এম এ আজিজ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “২০১৮ সালের জরিপে ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯৬৭টি অর্থ্যাৎ প্রায় তিন হাজার। এর মানে ২০১০ সালে করা অঙ্গিকারের কাছিকাছি গিয়েছে দেশটি। নেপালও বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এখন নেপালে ২৫০টি বাঘ রয়েছে। ভূটানেরও অবস্থা খারাপ না, দেশটিও লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি রয়েছে। তবে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা খারাপ। আগে যে বাঘ ছিল, এর থেকেও কমেছে।”

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্ন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের বন সংরক্ষক ছিলেন মোল্ল্যা রেজাউল করিম। সম্প্রতি ফরেস্ট একাডেমির পরিচালক পদে যোগ দিয়েছেন। গেল বছরগুলোতে বাঘ সংরক্ষণে নানা কর্মকাণ্ডের তথ্য তুলে ধরে তিনি বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে গ্লোবাল টাইগার ইনিসিয়েটিভের ভূমিকা আছে। আমরা বাঘসমৃদ্ধ দেশ, তাই বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাই এবং বাঘকে আরো সংরক্ষিত করতে চাই। বন বিভাগের যেসব কার্যক্রম চলছে তাতে যথেষ্ট ভালো অবস্থানে আছে বেঙ্গল টাইগার।”

বাংলাদেশ-ভারতে বাঘ সংরক্ষণ

বাংলাদেশ এবং ভারতের দশ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন যার ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ আছে ১১৪টি। এ সংখ্যা ২০১৫ সালের বাঘশুমারি থেকে আটটি বেশি। ভারতের ২০১৯ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ আছে ৯৬টি। দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালে ছিল ৮৭টি।

সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার/বাংলার বাঘ। ছবি: ফরিদী নুমান, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী।

দু’দেশের বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় সুন্দরবন অংশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেখানকার বন বিভাগ অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে ভারত অংশের সুন্দরবনে বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বাঘের সংখ্যা।

ভারতের বন্যপ্রাণী গবেষক কোস্তভ চৌধুরী বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ভারতের সুন্দরবনের ভেতর যে সকল আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করতো তাদের সরিয়ে অন্যত্র পুনর্বাসন করা হয়েছে। পাশাপাশি বাঘের চোরা শিকার ও পাচার রোধে বাঘের বিচরণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও জনসাধারণের চলাচল পর্যবেক্ষণ এবং সীমিতকরণ নিশ্চিত করা হচ্ছে।”

বাংলদেশে বাঘ বৃদ্ধির পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রফেসর ড.এম এ আজিজ জানান, “শুরুতেই বাংলাদেশ বলেছিল বাঘ দ্বিগুণ করা না গেলেও সংখ্যা যাতে না কমে সে উদ্যোগ নেয়া হবে, যদিও বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাঘের সংখ্যা না কমলেও বৃদ্ধির পথে আছে, যা আশাব্যঞ্জক।”

বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম উল্লেখ করেন, “এ বছরই কয়েক দফায় সুন্দরবনে কখনো পাঁচটা বাঘ বা কখনো চারটা বাঘ একসঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হয়েছে। গাছে বসে বাঘ ঝুলছে এমন ছবিও দেখা গেছে। এক জায়গায় তিনটি বাঘকে বিশ্রাম নিতেও দেখা গেছে। যেগুলো এই বছরই প্রথম, অতীতে কখনো এমন ঘটনা নেই। এগুলোই ভালো অবস্থানের ইঙ্গিত। আসছে শীত মৌসুমে বাঘ শুমারি শুরু করবে বন বিভাগ। এতে কতটুকু ভালো আছে বাঘ তা বিস্তারিত জানা যাবে।”

গবেষকদের মতে বাংলাদেশে কিছুদিন পূর্বেও সুন্দরবনের গহীনে বনদস্যু ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোলাগুলি ও অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। যদিও তা অনেকাংশে কমেছে। এরপরও বাংলাদেশের সুন্দরবনে মানুষের চলাচল ভারতীয় অংশ থেকে বেশি। মধু সংগ্রহ, গোলপাতা সংগ্রহ, মাছ ধরা, বনের কাঠ ও লাকড়ি সংগ্রহ করার জন্য মানুষ অবাধে প্রবেশ করছে বনে। ফলে বাঘ যেমন অনিরাপদ বোধ করছে, বাড়ছে বাঘ-মানুষ সংঘর্ষও। বর্তমানে বাঘ সংরক্ষণে সুন্দরবনে স্পার্ট পেট্রোলিংসহ নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট নয় বলছেন বাঘ বিশেষজ্ঞরা।

“সুন্দরবনে অনেক টহল ফাঁড়ি রয়েছে। কিন্তু এরপরও স্পার্ট পেট্রোলিংয়ের জন্য জনবল ঘাটতি রয়েছে। এজন্য একদিকে টহলও হচ্ছে অন্যদিকে অবৈধ কার্যক্রমও চলমান আছে। ভারতে করা এক জরিপে দেখা গেছে, সুন্দরবনের ভেতর যেসব চোরা শিকার বা পাচার হয়েছে এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। বাকিগুলো অজানা থেকে যায়,” যোগ করেন ড. এম এ আজিজ।

“বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণী সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বাঘকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এজন্য এখনই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এরই অংশ হিসেবে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং অভ্যন্তরীণ মানুষ সরিয়ে পুনর্বাসন করা উচিত। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঘ ও অন্য প্রজাতিদের সংরক্ষণে বনের ভেতর উঁচু পাড় দেয়া পুকুর খনন এবং সেগুলো নিয়মিত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন” যোগ করেন গবেষক ড. এম এ আজিজ।