চলতি বছরের মে ও জুন মাসে বাংলাদেশে বজ্রপাতে ১২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম। শনিবার এ তথ্য জানায় সংস্থাটি। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালের মে এবং জুন মাসে বজ্রপাতে সারাদেশে ১২৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ দুই মাসে বজ্রাঘাতে আহত হয়েছেন ৫৩ জন। নিহতদের মধ্যে ২১ জন নারী, ৭ জন শিশু এবং ৯৮ জনই পুরুষ। এর মধ্যে মে মাসে নিহত হয়েছে ৬০ জন এবং জুন মাসে ৬৬ জন। মে মাসে নারী ৯ জন, শিশু ৩ জন এবং ৪৮ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে মে মাসে আহত হয়েছেন ২৮ জন। জুন মাসে মোট নিহত হয়েছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে নারী ১২ জন, শিশু ৪ জন এবং ৫০ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন।
সংস্থাটি জানায়, জুন মাসে বজ্রাঘাতে মোট ২৫ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জ জেলায়। এ জেলায় গত দুই মাসে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ১৬ জন। সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল জেলায় বজ্রপাতে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গত দুই মাসে বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কিশোরগঞ্জে ১৬ জন, হবিগঞ্জে ৩জন, রাজশাহীতে ১০জন, চাপাইনবাবগঞ্জে ৯জন, পাবনায় ৬জন, দিনাজপুরে ৭জন, নীলফামারীতে ৪জন, জামালপুরে ৪জন, শেরপুরে ৪জন, নওগাঁয় ৬জন, সিরাজগঞ্জে ৫, নারায়ণগঞ্জে ৫জন, মৌলভীবাজারে ৩জন, খুলনায় ৪জন, সাতক্ষীরায় ১১জন ও টাঙ্গাইলে ৪ জনসহ বিভিন্ন জেলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
বজ্রপাতে নিহত হবার কারণ সম্পর্কে সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম জানায়, ধান কাটার সময় বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এরপর রয়েছে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় মাছ ধরতে গিয়ে। মাঠ থেকে গরু আনা এবং টিন ও খড়ের ঘরে অবস্থান ও ঘুমোনোর সময় বেশি মানুষ মারা গেছে বজ্রাঘাতে। একইসঙ্গে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় অজ্ঞতাবসত লম্বা গাছের নিচে আশ্রয় নেয়ার সময় গাছে বজ্রপাত হওয়ায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, যত্রতত্র মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানো এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। তাপমাত্রা যত বাড়বে বজ্রপাতও ততো বাড়বে। তাপমাত্রা গড়ে এক ডিগ্রি বেড়ে গেলে বজ্রপাত ১০ শতাংশ বার তার চেয়ে বেশি বজ্রপাত বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইদানীং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এই কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে বজ্রপাতের পরিমাণ। বিদ্যুতপ্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয় অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে দ্রুত শক্ড হয়, ঠিক একইভাবে বজ্রপাতেও মানুষ শক্ড হয়ে মারা যায়। কারণ মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়।
যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্রপাত হওয়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ না থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুৎ পরিবাহীর চেয়ে বেশি তাহলে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। সরাসরি মাটিতে সাধারণত বজ্রপাত হয় না। বজ্র বিদ্যুৎ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর ওই পরিবাহির মাধ্যমে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উঁচু গাছ, ভবন, পাহাড়ের শীর্ষে সাধারণত বজ্রপাত হয়। বাসাবাড়িতে লাগানো বজ্রপাত নিরোধক দ-ের ওপরও বজ্রপাত হয়।
বজ্রপাতের সময় করণীয়: বিশেষ করে যারা ঘরের বাইরে ক্ষেতখামারে কাজ করে তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। যে স্থান বা বস্তু যত উঁচু সে স্থান মেঘের তত সন্নিকটে থাকায় সেখানে বজ্রপাতের সম্ভাবনা তত বেশি। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু স্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। মৌসুমে ঘনকালো (ঝড়মেঘ) মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। পাকা বাড়িতে আশ্রয় নেয়া বেশি নিরাপদ। তবে পাকাবাড়ি সুউচ্চ হলে সেক্ষেত্রে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় জানালার কাছে না থাকাই ভালো। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল পরে থাকা এবং পানি ও যে কোনো ধাতববস্তুর যেমন সিঁড়ির বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনো বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়। বজ্রপাতে বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেগুলো ইলেকট্রিক সংযোগ বা ডিসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা ভালো। এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় থাকলে যদি বজ্রপাত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয় তাহলে কানে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে বসে থাকতে হবে। তবে মাটিতে শোয়া যাবে না, কেননা মটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গাড়িতে থাকা অবস্থায় বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে গাড়ির মধ্যে থাকায় নিরাপদ। তবে মনে রাখতে হবে গাড়ির ধাতব কোনো অংশের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে তাল গাছ জাতীয় সুউচ্চ প্রজাতির গাছ প্রচুর পরিমাণে মাঠের মধ্যে লাগাতে হবে।
বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তিদের মতো। শরীর থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক চার্জ অপসারণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শরীরে ম্যাসেজ করতে হবে। আহত ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণে বিচলিত না হয়ে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।