বাধ্য হয়ে নিজ পথ খুঁজে নিচ্ছে বন্যহাতিরা!

বুনো এশিয়ান হাতি। ছবি: মনিরুল হাসান খান, প্রাণীবিদ।
(ঢাকা, বাংলাদেশ): বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতসহ এই অঞ্চলের বদলে যাওয়া ভূচিত্রে হাতিরা যেন নীরব যোদ্ধা। ক্রমশ তারা আবাসস্থল হারাচ্ছে, কমছে বিচরণ ক্ষেত্রসহ বনভূমি, তবুও তারা হাল ছাড়েনি। প্রাচীন অভ্যাসের সাথে নতুন বাস্তবতায় হাতিরা নিজেরাই পথ খুঁজে নিচ্ছে। কোন কোন সময় রাতে মানুষের চোখ এড়িয়ে চলেছে, কখনো দিনের আলোয় নির্জন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।

এশীয় প্রজাতির হাতির সংখ্যা হিসেব করলে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের আসাম রাজ্য। গত দুই দশকে আসামের বনভূমি দ্রুত বদলে চা বাগান, কৃষিজমি ও বসতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে হাতির চলাচলের পথ ও আবাসভূমি বিলুপ্ত হচ্ছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে হাতি কি করছে তা জানতে ২০২১ সালে পাঁচটি হাতিকে জিপিএস কলার পরিয়ে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড (ডাব্লিউডাব্লিউএফ)। এতে সহযোগিতা করে আসাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট।

সম্প্রতি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডাব্লিউডাব্লিউএফ । ওই কার্যক্রমের শুরুতে প্রথমে ‘তারা’ নামের একটি হাতিকে কলার পরানো হয়। পরে ‘ফুল’, ‘মাইনাও’, ‘বুধুনি’, এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে ‘বিশু’ নামের একটি পুরুষ হাতিকে কলার পরানো হয়।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, তারা ও ফুল বছরের বড় একটি সময় নামেরি জাতীয় উদ্যান ও সোনাই রূপাই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে নিরাপদে কাটায়। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে ধান কাটার মৌসুমে হাতিগুলো দক্ষিণমুখী যাত্রা করে। রাতে চুপিচুপি কৃষিজমি পেরিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে এবং দিনে চা বাগান বা সংরক্ষিত বনভূমিতে বিশ্রাম নেয়।

অন্যদিকে মাইনাও ও বুধুনি ভুটান সীমান্তঘেঁষা উদালগুড়ি জেলায় তাদের পালসহ বন, চা বাগান এবং কৃষিজমির মিশ্রণ আছে এমন ভূমিতে চলাচল করে। তবে এই দুই জেলার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো স্থানীয় জনগণের হাতির প্রতি সহনশীলতার মাত্রা।

শেরপুরের বনে বন্যহাতির পাল। ছবি: শাহানুল করিম চপল

সোনিতপুরে একসময় প্রতিশোধমূলক হত্যার হার অনেক বেশি ছিল। যেখানে একসময় হাতিকে বিষ প্রয়োগ করে অথবা উচ্চ-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তার দিয়ে হত্যা করা হতো। যদিও সময়ের সাথে সাথে এসব ঘটনার হার কমেছে। হাতিরা এখনো ব্রহ্মপুত্র নদীর সংযোগ রক্ষায় নতুন নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছে। এই অঞ্চলের মানুষ চা বাগান ও অন্যান্য এলাকা থেকে হাতি তাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা বেশি।

অন্যদিকে, উদালগুড়ি জেলার স্থানীয়রা নিজেদের ফসল রক্ষায় নানা পদ্ধতি ব্যবহার করলেও হাতিদের প্রতি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সহনশীল। তারা খুব কমই হাতিদের তাড়া করে। এই কারণেই মাইনাও ও বুধুনি দিনের বেলাতেও চা বাগানে থেমে থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে।

এছাড়া ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের পাল ভুটানের সীমানা অতিক্রম করে চলে যায়। শুষ্ক মৌসুমে তারা পানির খোঁজে ভুটানের ঘন জঙ্গলে চলে যায়। আর বর্ষার মৌসুমে ভারতে অবস্থান করে, কারণ তখন সেখানে ফসল এবং অন্যান্য খাদ্যের সহজলভ্যতা থাকে।

সবশেষে বিশুর গতিবিধি থেকে জানা যায় সে বিভিন্ন ব্রহ্মপুত্র নদীর দ্বীপাঞ্চলে যায় এবং আবার ফিরে আসে। এই পাঁচটি জিপিএস-কলার পরানো হাতি এবং তাদের পালকে পর্যবেক্ষণ করছে গবেষকরা। আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছে কিভাবে হাতিরা বদলে যাওয়া পরিবেশ ও মানুষের মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়ার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে।

গবেষণাটির মাধ্যমে একটা বিষয় পরিস্কার হাতিরা টিকে থাকার জন্য তাদের আচরণে পরিবর্তন আনছে। এটি কার্যকর এবং তথ্যভিত্তিক সংরক্ষণমূলক উদ্যোগ নিতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যা শেষ পর্যন্ত মানুষ এবং হাতি উভয়ের জন্যই ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে।

লেখক: সাংবাদিক