বাঘ-চিতা ও একটি টাইম মেশিন

আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে বাংলাদেশের অনেক বনেই দেখা মিলত বাঘেদের। পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের অরণ্যতো বটেই তখন সিলেটের বিভিন্ন জঙ্গল, মধুপুরের শালবনসহ গারো পাহাড় পাদদেশের এলাকাগুলোতেও দেখা মিলত তাদের। চিতা বাঘের আনাগোনা ছিল তখন গভীর অরণ্য ছাপিয়ে অনেক গ্রামীণ বনেও।

আমার প্রায়ই মনে হতো আহা অর্ধ শতাব্দী আগেও যদি জন্মাতাম কী মজাটাই না হতো। বাঘ-চিতা বাঘের দেখা পাওয়াটা অনেক সহজ হতো। কিংবা নিদেনপক্ষে এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিন যদি বাস্তব হয়ে যেত তাহলেও হতো। অতীতে চষে বেড়িয়ে খুঁজে নিতাম প্রিয় বাঘ, চিতা বাঘ কিংবা গণ্ডারকে।

তারপরই হঠাৎ করে আমাদের দেশে যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় বাঘ-চিতা বাঘ দেখা যাওয়ার কাহিনি শোনা যেতে শুরু করল, মনে হলো আমরা টাইম ট্র্যাভেল করতে না পারলেও এসব প্রাণী কী টাইম ট্র্যাভেল করা শুরু করল নাকি। নাহলে পূর্বাচলে বাঘ, টাঙ্গাইলে চিতা বাঘ কিংবা শেরপুরে বাঘ আসে কীভাবে? এবার বরং একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক…

এক

আগস্টে কয়েক দিনের জন্য দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এ সময়টা বিস্তর ঘুরাঘুরি করায় দেশের খবর একটু কম নিতে পেরেছিলাম। একদিন হঠাৎ দেখলাম ফেসবুকের মেসেঞ্জারে পরচিতি একজন পূর্বাচলে বাঘের আনাগোনার একটা খবর শেয়ার করে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন।

খবরটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আহা! সত্যি যদি এমন হতো! চিতা বাঘতো বছর ষাটেক আগেও এদিকটায় ছিল। ওই সময় ঢাকার উত্তরা আর মিরপুরে চিতাবাঘ শিকারের কথা বলেছেন এনায়েত মওলা তাঁর ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে। বাঘকে খুঁজতে হয়তো আরও কয়কেটা যুগ পেছনে যেতে হবে এসব এলাকায়। তবে কী টাইম মেশিনের দরকার নেই।

দেশে ফিরে পূর্বাচলের ঝোপ-ঝাড়ে খুঁজলেই পেয়ে যাব বাঘেদের। তবে আমি জানতাম এটা দিবা স্বপ্নের চেয়েও অবাস্তব। পরে ছবি দেখতেই বুঝলাম টিভি চ্যানেলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জায়গা করে নেওয়া পূর্বাচলের ওই বাঘ আসলে মোটামুটি নিরীহ ধরনের আশ্চর্য সুন্দর সেই প্রাণী মেছো বিড়াল। আমার জানা নেই ওই খবর প্রকাশের পর পূর্বাচলের মেছো বিড়ালদের এখন কী অবস্থা। তবে একে একে দেশের আশ্চর্য সুন্দর বন্যপ্রাণীদের আমরা যেভাবে পিটিয়ে মেরে বিলুপ্ত করে ফেলেছি কিংবা হুমকিতে ফেলে দিয়েছি তাতে মনে একটা কু গাইছে।

দুই

পরের ঘটনাটা পরের মাস, মানে সেপ্টেম্বরের। হঠাৎ শুনলাম টাঙ্গাইলে চিতা বাঘ দেখা গেছে। কোথায় তখনো শুনি নি। তবে বরাবরই খুব আশাবাদী মানুষ। আর যেহেতু টাঙ্গাইল আর চিতা বাঘ দুটো জিনিস কমন পড়েছে আমার শরীর-মনে একটা রোমাঞ্চ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। কারণ একটা সময় টাঙ্গাইলের মধুপুর আর গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় ছিল চিতা বাঘদের আড্ডাখানা। আমার ধারণা স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও মধুপুরে কিছু চিতা বাঘ ছিল। এমনকী গত শতকের আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত ও ওদের দুই-একটা ওই অঞ্চলে বেঁচে থাকাটা একেবারে অসম্ভব ছিল না।

তারপরও অতি আশাবাদী আমি এখনও ভাওয়ালের গড় কিংবা মধুপুরে চিতা বাঘ আছে কিনা এটা নিয়ে মনিরুল খান ভাই আর সরওয়ার পাঠান ভাইয়ের সঙ্গে যুক্তি-তর্ক কষার চেষ্টা করি। কারণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মনিরুল খান ভাইয়ে বাড়ি টাঙ্গাইলে। আর ওই অঞ্চলের অরণ্যও তাঁর নখদর্পণে। আর বন্যপ্রাণীপ্রেমী সরওয়ার পাঠান ভাইয়ের ভাওয়ালের গড় ও গাজীপুররে শালবনে ছিল বিস্তর যাতায়াত। কিন্তু আশার আলো পাইনি কোথাও। কয়েক দশক আগেই গড়ের রাজা চিতা বাঘেরা বিদায় নিয়েছে সন্দেহ নেই।

তারপরও বললাম না, অতি আশাবাদী আমার মনে ঠিকই কাঁপন ধরল। মধুপুরের গহীনে দু-একটা এখনো আছে নাকি? তারপরই শুনলাম জায়গাটা সখিপুর। সঙ্গে সঙ্গে আশার বেলুনটা ফাটল। ধরে নিলাম তিলকে তাল করা হচ্ছে। মেছো বিড়াল বা গন্ধ গোকুলকে চিতা বাঘ বানানো হচ্ছে। পরে বেত বনের ওই চিতা বাঘের ছবি দেখে তো থ! আরে এ তো চিতা! চিতা বাঘই নয়। কেউ ফটো শপের কারসাজিতে ডাঙার দ্রুততম জন্তুকে সখিপুরে হাজির করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বন বিভাগ তদন্ত করতেই ওই ছেলে স্বীকার করল আসলেই চিতার ছবিটা সে বসয়েছেে, বেত বাগানের মধ্যে কারসাজি করে।

তিন

পরের ঘটনাটি এই অক্টোবরের। অবশ্য গুজবটা নাকি ছড়িয়েছে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ও পাশের বনে বাঘ দেখার গুজব। গ্রামের কয়েকজন কৃষক ও বন বিভাগের সুফল বাগানের কয়েকজন পাহারাদারসহ আরও কারো কারো দাবি, ১৫ দিনে ওই বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছে ১৫-১৬টি গরু-ছাগল। ওই মানুষদের ধারণা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের গারো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এ বাঘ।

এবার একটু যুক্তি-তর্ক দিয়ে বিচার করা যাক। ভারতের সর্বশেষ বাঘ জরিপ অনুযায়ী গোটা মেঘালয় রাজ্যে কোনো বাঘ নেই। আর গারো পাহাড়সহ খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের অবস্থান মেঘালয়ে। যেখানে গোটা মেঘালয়ে বাঘ নেই বলা হচ্ছে সেখানে ঝিনাইগাতীতে বাঘের অস্তিত্ব কাল্পনিকই মনে হচ্ছে। তবে গারো পাহাড় কিংবা খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ে একটিও বাঘ নেই আর এ বিষয়ে একশ ভাগ নিশ্চিত নই আমি। তবে অতি আশাবাদী আমার হিসেবে একটা-দুটো থেকে থাকলেও সেখানকার গহীন অরণ্যে! তবে অফিশিয়ালি সেখানে আছে চিতা বাঘ আর বন্য কুকুর।

এ দুটোর সম্ভবনা নিয়ে বরং ভাবা যাক। আমাদের শেরপুরের প্রতিনিধি জুবাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জেনেছি কিছু মানুষ বাঘ দেখা যাওয়ার কথা বললেও অনেক মানুষই এ বিষয়ে সন্দিহান। এমনকী গারো পাহারের পাদদেশে বাস করা গারো এবং কোচরাও পাহাড়ে বাঘের আনাগোনার কোনো খবর জানেন না। এমনকী জুবাইদুলসহ কয়েকটি চ্যানেল ও পত্রিকার প্রতিনিধিরা ওই এলাকায় ঘুরাফেরা করে সেই তথাকথিত বাঘের আক্রমণে নিহত কোনো ছাগল বা গরুর মড়ি আবিষ্কার করতে পারেননি। এমনকী যে ছেলেটা বাঘের আক্রমণের শিকার

হয়েছে বলে শুনেছেন তার সঙ্গে কথা বলেও জেনেছেন ভিন্ন কথা। প্রাণীটা তাকে আক্রমণ করেনি। কেবল সামনে পড়েছিল। তার দেওয়া তথ্যে ওটার দৈর্ঘ্য কেবল চার ফুট, উচ্চতা তিন ফুটের মতো।

চেহারাাট শিয়ালের সঙ্গে মিল আছে। আরও দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শীও মোটামুুটি এ বিবরনই দিয়েছে সেই বাঘের! আর একটা খবর পেয়েছিলাম, যদিও আমি নিশ্চিত নই, ওই এলাকায় যে প্রাণীটার আনাগোনার খবর পাওয়া গেছেে সেটির পায়ের ছাপ নাকি কুকুরের মতো। সব কিছু মিলিয়ে, সত্যি দু-একটা দুর্ঘটনা ঘটে থাকলে খলনায়ক শিয়াল, সর্বোচ্চ বন্য কুকুর বা ঢোল হতে পারে।

Embed from Getty Images

চার

এবার উপসংহার টানব। প্রতি মাসেই যেভাবে বাঘ, চিতা বাঘ নিয়ে একটা করে গুজব ছড়াচ্ছে, আমি আতংকে আছি সামনের মাসে নাকি আবার শুনি আমার বাসা শান্তিনগর কিংবা অফিস বনশ্রী বা পাশের কাশফুলরাজ্য আফতাব নগরে বাঘের আনাগোনার খবর পাই। এই গুজবগুলোতে আমার মনে আরেকটা ভয় কাজ করে। সাধারণত এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তখন অরণ্যের কিছু নিরপরাধ বন্যপ্রাণীও তাঁদের হাতে মারা পড়তে পারে।

এভাবে মানুষের হাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক বছরে কয়েকটি চিতা বাঘের মৃত্যু হয়েছে। আরও একটা সমস্যা আছে! একটা সময় বাংলাদেশে চিতা বাঘ খুব পরিচিত জন্তু ছিল। চা বাগান এলাকা এমনকী গ্রামীন বনেও দেখা মিলত তাদের। এখন এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি বনে। তাই এদের সম্পর্কে কোনো ঘটনা বা রটনা ছড়ালে স্থানীয় বাসন্দিারা আতংকিত হয়ে এদের মেরে ফেলাটাই সবচেয়ে সহজ সমাধান মনে করে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো গত কয়কে দশকে আমরা মানুষেরাই বেশিরভাগ বন থেকে এদের বিদায় করেছি।

তাছাড়া আরেকটি ব্যাপার আছে। আমাদের দেশে এখন মোটামুটি মেছো বিড়াল পর্যন্ত আকারের প্রাণীদের উদ্ধার করতে পারলে এখন বনে ছেড়ে দেওয়ার একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এটা নি:সন্দেহে ভালো ব্যাপার। তবে এরচেয়ে বড় প্রাণী যেমন চিতা বাঘ, মেঘলা চিতা বা ভালুকের বেলায় পরস্থিতিটা এখনো কঠিন।

আমার চাওয়া কোনো লোকালয়ে চিতা বাঘ দেখা গেলে এবং ধরা পড়লে তাকে যেন চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে বন্দী করা না হয়। কোনো বনেই ছাড়া হয়। তা ছাড়া পাশের দেশ ভারত যেমন দেশে চিতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে, আমাদের যেসব বনে চিতা বাঘ, ময়ুর, গণ্ডারদের বিচরণ ছিল আবার সেগুলোর কোনো কোনোটায় ওই সুন্দর প্রাণীগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হবে এই স্বপ্নই দেখি।

লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশ।