বাংলাদেশ থেকে আরও একটি নতুন প্রজাতির ব্যাঙ পেল বিশ্ব। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া বনে ব্যাঙটি আবিষ্কার করেন বন্যপ্রাণী গবেষক দম্পতি হাসান আল-রাজী ও মার্জান মারিয়া। নতুন ব্যাঙের বাংলা নাম রাখা হয়েছে সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ। ইংরেজি নাম দেয়া হয়েছে সিলেটি লিটার ফ্রগ। ২৮ মে, শুক্রবার জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রকাশ হয় নতুন ব্যাঙের গবেষণাপত্র। এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায় গবেষণাটি। এটি বাংলাদেশের তালিকার ৫৭তম ব্যাঙ প্রজাতি হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে।
বেঙ্গল ডিসকাভার-কে এই দম্পতি জানান, সদ্য আবিষ্কৃত ব্যাঙটিকে আগে লেপ্টোব্রাকিয়াম স্মিথি/Leptobrachium smithi প্রজাতির মনে করা হতো। কিন্তু এই ব্যাঙটির বিস্তৃতি বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। আর এই বিস্তৃত মাঝেই আরো দুটি এই গণের ব্যাঙ পাওয়া যায়। একটি লেপ্টোব্রাকিয়াম রাখাইনেন্সি/Leptobrachium rakhinense/ অন্যটি লেপ্টোব্রাকিয়াম টেনাসসেরিমেন্সি/Leptobrachium tenasserimense। এসব কিছু চিন্তা করে আমাদের মনে হয় যে এ দেশে লেপ্টোব্রাকিয়াম/Leptobrachium গণের যে প্রজাতিটি আছে সেটা কোনভাবেই লেপ্টোব্রাকিয়াম স্মিথি হতে পারে না।
গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই লেপ্টোব্রাকিয়াম গণের ব্যাঙগুলো লেপ্টোব্রাকিয়াম সিলেটিকাম/Leptobrachium sylheticum এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ব্যাঙগুলো লেপ্টোব্রাকিয়াম সিলেটিকাম অথবা লেপ্টোব্রাকিয়াম রাখাইনেন্সি। ব্যাঙগুলো মূলত বনের গহীনে দেখা যায়। ঝরা পাতার মধ্যে মিশে থাকে ব্যাঙটি, তাই সেখানে যে কোন ব্যাঙ আছে তা বোঝার উপায়ও থাকে না। তবে প্রজননের সময় ঝরা পাতা থেকে ছড়ায় নেমে আসে এই ব্যাঙ।
গবেষণা পদ্ধতি প্রসঙ্গে গবেষক দম্পতি জানান, লেপ্টোব্রাকিয়াম সিলেটিকাম যে নতুন প্রজাতির ব্যাঙ সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে শারীরিক পরিমাপ, এদের মলিকুলার বিশ্লেষণের পাশাপাশি ডাকের বিশ্লেষণও করা হয়েছে। এতে এই গণের অন্য ব্যাঙ থেকে যে সিলেটি লিটার ফ্রগ/Sylheti Litter Frog পুরোপুরি ভিন্ন তা প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষক হাসান আল-রাজী বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”ছড়ার প্রবাহমান স্বচ্ছ পানিতে ডিম দেয় এরা। ডিম ফুটে ব্যাঙ্গাচীগুলো বড় হয় ছড়ার পানিতে। ঝরা পাতায় থাকে বলে এই ব্যাঙকে ইংরেজিতে লিটার ফ্রগ/Litter Frog বলে। তাই আমরা এই ব্যাঙের ইংরেজি নাম দিয়েছি- সিলেটি লিটার ফ্রগ/Sylheti Litter Frog; বাংলা নাম- সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ।”
”ব্যাঙটি নিয়ে যখন গবেষণা শুরু করি তখনই আমাদের সঙ্গে রাশিয়ান প্রফেসর নিক পোয়ারকভের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনিও এই ব্যাঙের প্রজাতি বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একমত হন। পরে আমরা তিনজন মিলে একটি গবেষণা পরিকল্পনা করে জুনের মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করি। পুরো কার্যক্রমটি রাশিয়া থেকেই সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং সার্বিক সহযোগিতা করেন প্রফেসর নিক পোয়ারকভ,” উল্লেখ করেন তিনি।
কোভিড পরিস্থিতিতে গবেষণা পরিচালনা করতেও বেগ পেতে হয়েছে গবেষকদের। হাসান আল-রাজী বলেন, ”২০২০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে যখন লকডাউন চলছিল। তখন বনবিভাগের দেয়া গবেষণার অনুমতির সময়সীমাও শেষ হতে বাকি ছিল মাত্র একমাস। তাই আমরা বাধ্য হয়ে কোভিড পরিস্থিতিতে লকডাউনেও গবেষণা চলমান রাখি। আমরা জুনের ১৮ তারিখে রংপুর থেকে শ্রীমঙ্গলে যাই। সাতদিন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পুনরায় বাড়িতে ফিরে কোয়ারেন্টিন করি। এরপরে ল্যাবে চলে বাকি গবেষণা।”
বাংলাদেশে নতুন ব্যাঙের আবিষ্কারক তরুণ গবেষক দম্পতির ভাষ্য:
মার্জান মারিয়া বলেন, ”এই আবিষ্কারে অনুভূতি ভাষার ব্যক্ত করা কঠিন। কারণ বাংলাদেশে নতুন কিছু আবিষ্কার করে বিশ্বে নিজ দেশকে তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে আমরা গর্বিত। এটা ভেবেই ভালো লাগছে যে, এই ব্যাঙের কথা যতোবার স্মরণ করা হবে ততোবারই বাংলাদেশের নামও উল্লেখ হবে। ভবিষ্যতে এমন আরো কাজ করতে চাই।”
হাসান আল-রাজী আক্ষেপ করে বলেন, ”এই ব্যাঙ আবিষ্কার করে অনেক আনন্দিত কিন্তু একই সাথে দু:খবোধও করছি। কারণ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বন রূপ হারাচ্ছে। বিশ্বে লাউয়াছড়া বন থেকে সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙসহ দুটি নতুন ব্যাঙ আবিষ্কৃত হয়েছে। আরো পাওয়ার সম্ভবনাও রয়েছে। কিন্তু বনের যে ছড়াগুলোতে ব্যাঙ প্রজনন করে সেগুলোর বেশিরভাগই শুকিয়ে গেছে। এমনটা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ আর লাউয়াছড়া বনে পাওয়া যাবে না। তাই ব্যাঙ সংরক্ষণে ছড়াগুলোও রক্ষা করতে হবে।”