জুটি খুঁজতে বন সুন্দরীর ডাক

বনসুন্দরী, নওরঙ, সাদা হালতি পাখি। আলোকচিত্রী: লেখক।

প্রকৃতির মূল অংশ হচ্ছে পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, গাছপালা ও বন-জঙ্গল। বনের শোভা হচ্ছে বন্যপ্রাণী ও পাখি। তবে বাংলাদেশের বনগুলোতে নানা ধরনের পাখির দেখা মেলে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনই একটি পাখি হচ্ছে বন সুন্দরী। পাখিটিকে নি:সন্দেহে বনের সৌন্দর্য বলা যায়। যে কেউ এই পাখিকে ’বনের অলঙ্কার’ ও বলতে পারেন।

পাখিটির বাংলা নাম- বনসুন্দরী, নওরঙ, সাদা হালতি; বৈজ্ঞানিক নাম- Pitta brachyuran; ইংরেজি নাম- Pitta brachyuran। তবে বাংলা নাম কেন ‘বন সুন্দরী’ রাখা হলো, যে কেউ একনজর দেখলেই বুঝবেন। ভারতে এর নাম নওরঙ। আমাদের দেশে পাখি বিশারদগণ নাম দিয়েছেন বন সুন্দরী ও সাদা হালতি। কেউ কেউ ‘দেশি সুমচা’ বলে থাকেন।

এরা খড় জঙ্গল, পচনশীল এবং ঘন চিরহরিৎ বনে বাস করে। গজারী বন ও শাল বনে এরা বাসা বানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মূলতএদের জন্ম হিমালয়ের জঙ্গলে। শীত মৌসুমে এরা পশ্চিম ভারতের পাহাড়ের কিছু অংশে বা অন্যান্য উপদ্বীপে স্থানান্তরিত হয়। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে প্রজননের জন্য ভারত ও আশপাশের দেশগুলোতে চলে যায়। আকারে খুবই ছোট একটি পাখি। ওজন ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম। অন্যান্য পাখি থেকে এদের জীবন বৈচিত্র্য ও স্বভাব চরিত্র একটু আলাদা।

এরা আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি হিসেবে পরিচিত। এই একটিমাত্র পরিযায়ী পাখি আামদের দেশে প্রজনন করে বাচ্চাফুটিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। বনসুন্দরী হওয়ার পিছনে এদের শরীরের রংটাই মূল কারণ। নয় রঙের সমাহারে সমৃদ্ধ বনসুন্দরী পাখি। মাথায় সোনালী রঙের মাঝখানে কালো দাগের মুকুট পড়া। গলায় সাদা হারের মতো অলঙ্কার ও চোখে কাজল পড়া। ঘাড় কালো ও বুক অনেকটাই সোনালী হলদে। সবুজ নীল মিশ্রণের পিঠ। লেজ ছোট। পেটে লাল বর্ণ পাখিটির সব সৌন্দর্যই যেন প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছে নিজ হাতে।

এদের দীর্ঘ শক্তিশালী পা। এই পা দিয়ে মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। খাদ্যের খোঁজে মাটিতে অনবরত লাফাতে থাকে আর পা দিয়ে বনের পাতা সরিয়ে খাদ্য খুঁজে বেড়ায়। বনের মাটিতেই এরা বেশি বিচরণ করে। বনের ঝরে যাওয়া পাতা যখন পঁচে তখন সেই পাতার নিচে পোকা-মাকড় ও কেঁচো জন্ম নেয়। এরা বনের পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে ঠোঁট দিয়ে খাবার খুঁজে খায়। যার জন্য সর্বক্ষণ তাদের ঠোঁটে মাটি লেগে থাকে।

খাবারের মাঝে মাঝে বনের ভিতরে গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নেয়। কেঁচো ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী এদের প্রধান খাবার। খাবারের সংকট দেখা দিলে মাঝে মাঝে পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এরা একাকী চলাফেরা করতে পছন্দ করে। জোড়ায় জোড়ায় খুব একটা দেখা যায় না। প্রজননের জন্য জোড়া বাঁধার পর থেকে এরা ব্যস্ত থাকে বাসা বানানো ও বংশবৃদ্ধির জন্য।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ভালুকার শালবনে সর্বপ্রথম এই পাখি নথিভুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলে। কুষ্টিয়া, বগুড়া, মধুপুর বন, দিনাজপুর বন, শেরপুর ও ঢাকার গাজীপুরের শালবন ও ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় বনসুন্দরী বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। তারা এই অঞ্চলগুলোতে প্রজনন করে সফলতার সঙ্গে বাচ্চা ফুটাচ্ছে।

এদের প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। প্রজননের জন্য মেয়ে পাখিটিকে আকর্ষণ করার জন্য মিষ্টি সুরে ডাকতে থাকে। এরা ক্রমাগতভাবে মিষ্টি সুরে তার সঙ্গীনিকে ডাক দেয়। এরই মধ্যে মেয়ে পাখিটি পুরুষ পাখির ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে। তবে শোনা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষ পাখির ডাকে মেয়েপাখি সাড়া না দেয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত অনবরত ডাকতে থাকে। ডাকতে ডাকতে গলা দিয়ে রক্তও নাকি ঝরতে থাকে।

বর্তমানে শালবনে গাছ চুরি ও বন কেটে উজাড় করার জন্য এই পাখিগুলো এ দেশে হুমকির মুখে পড়েছে। প্রকৃতি বাঁচলে এইপাখিগুলোও বাঁচবে। তাই আমাদের সচেতন হওয়া উচিত এদের রক্ষা করার জন্য।

লেখক: বাংলাদেশের বন্যপ্রাণ বিষয়ক আলোকচিত্রী।