বিকল্প নেই সুসমন্বিত ‘ডিভিএম’ ডিগ্রীর

(ঢাকা, বাংলাদেশ): ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে কুমিল্লায় প্রাণিচিকিৎসা কলেজে ৩ বছর মেয়াদী প্রাণিচিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার বিষয়ের ডিপ্লোমা কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাণিচিকিৎসা শিক্ষার সূচনা। ১৯৫১ সালে কলেজটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে ১৯৫৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রাণিচিকিৎসা কলেজ ও পশুপালন’ নামে পরিবর্তিত হয়।

১৯৬২ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে প্রাণিচিকিৎসা শিক্ষা খাতে পৃথকভাবে ৭০ শতাংশ পাঠ্যক্রমে প্রাণিচিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ডিভিএম ডিগ্রি এবং ৩০ শতাংশ পাঠ্যক্রমে পশুপালন অন্তর্ভুক্ত করে পশুপালন ডিগ্রি প্রবর্তন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (পবিপ্রবি) ডিগ্রি দুটি আলাদাভাবে চালু করা হয়।

দক্ষ ও সময়োপযোগী প্রাণিচিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যে উল্লিখিত দুই ডিগ্রিকে সমন্বিত করে পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যক্রমে সিলেট প্রাণিচিকিৎসা কলেজ এবং চট্টগ্রাম প্রাণিচিকিৎসা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে। পরবর্তীতে ২০০৬-০৭ সালে এই বিশেষায়িত কলেজ দুটি যথাক্রমে চট্টগ্রাম প্রাণিচিকিৎসা ও পশুবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) রূপান্তরিত হয়।

এখানে লক্ষণীয়, মাত্র দশ বছর ব্যবধানে অপ্রত্যাশিত মনস্তাত্ত্বিক ডিভিএম-পশুপালন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আন্তঃদ্বন্দ্বে ‘প্রাণিচিকিৎসা’ শব্দের সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘কৃষি’ ও ‘পশুবিজ্ঞান’ যুক্ত করা হয়। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রাণিচিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিভাসু, ১১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ১৩টি প্রতিষ্ঠানে ‘প্রাণিচিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক’, ‘প্রাণিচিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি’ এবং ‘পশুপালন’ — এই তিনটি ভিন্ন নামে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন এখন দুটি প্রযুক্তিগত পদ রয়েছে— প্রাণিসম্পদ ক্যাডার এবং পশুপালন ক্যাডার। এখনো সম্মিলিতভাবে ‘প্রাণিসম্পদ ক্যাডার’ নামকরণ হয়নি।

সাধারণত এক বছর ইন্টার্নশিপসহ পাঁচ বছর মেয়াদি কোর্স শেষ করে একজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ প্রাণিচিকিৎসা কাউন্সিল নিবন্ধিত প্রাণিচিকিৎসক হন। উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের মধ্যে পশুপালন বিষয়ের কোর্স চার বছর মেয়াদি, কিন্তু তিনটির ক্ষেত্রেই উচ্চ মাধ্যমিকে আবেদনযোগ্যতা অভিন্ন। অর্থাৎ, সকল প্রাণিচিকিৎসক পশুপালনবিদ হন, কিন্তু সকল পশুপালনবিদ প্রাণিচিকিৎসক নন।

পশুপালন ডিগ্রি নিয়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর মাত্র ২৫০ জন স্নাতক বের হন। অন্যদিকে বাকি ১১টি প্রতিষ্ঠান থেকে সমন্বিত কোর্সভিত্তিক ডিভিএম কিংবা প্রাণিচিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হন প্রায় ১২০০ জন। শতাংশ হিসেবে ৮৫ ভাগ প্রাণিচিকিৎসক, ১৫ ভাগ পশুপালনবিদ।

বাংলাদেশে তিনটি প্রধান পেশাগত নিবন্ধন কাউন্সিল হলো— বাংলাদেশ চিকিৎসক ও দন্ত চিকিৎসক কাউন্সিল, বাংলাদেশ প্রাণিচিকিৎসা কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। বাংলাদেশ প্রাণিচিকিৎসা কাউন্সিলে নিবন্ধিত একজন রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার হিসেবে আমার গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখান থেকে সমন্বিত/অসমন্বিত/আলাদা নামে তিন ধরনের ডিগ্রিধারী নিবন্ধিত হচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো একই কাউন্সিল থেকে নয় ধরনের ডিগ্রি প্রদান করতে হবে।

দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত প্রাণিচিকিৎসা সেক্টর। কিন্তু অপরিকল্পিত নীতির কারণে এ খাত এখনো অন্ধকারে। বাংলাদেশের বয়স এখন ৫৪ বছর। মাতৃপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিভিএম কোর্স পাঁচ বছর মেয়াদি হলেও ইন্টার্নশিপ মাত্র ৬ মাস। অসামঞ্জস্যতা কেবল পৃথক পশুপালন ডিগ্রি, যা আবার পবিপ্রবিতেও আছে। সর্বোচ্চ ২২৮ ক্রেডিট ঘন্টা বিশিষ্ট পাঠ্যক্রমে প্রাণিচিকিৎসা ও পশুপালন ডিগ্রি প্রদান করছে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

অন্যদিকে একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান সিভাসুর ডিভিএম কোর্সের ক্রেডিট সংখ্যা ১৮২। স্বার্থান্বেষী ও অপরিকল্পিত ডিগ্রি বিভাজনের কারণে বর্তমানে প্রাণিচিকিৎসকদের তীব্র চাকরি সংকট বিরাজ করছে। প্রতি বছর প্রায় ১৬টি উৎস থেকে ২০০০ এর বেশি অর্ধপ্রস্তুত প্রাণিচিকিৎসা স্নাতক বের হচ্ছে। কিন্তু তারা কেন এই পেশায় এসেছে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অনেকেরই নেই।

এছাড়া গত দেড় দশকে প্রাণিচিকিৎসকদের জন্য নতুন কোনো কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি। তাই দেশের সবকটি প্রাণিচিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম, বিদ্যমান ক্রেডিট সংখ্যা ও গুণগত মান অভিন্ন রেখে, একটি সুচিন্তিত ‘এক স্বাস্থ্য’ (ওয়ান হেলথ) নীতির আলোকে যুগোপযোগী, টেকসই, সমন্বিত শিক্ষানীতি তৈরি করা প্রয়োজন। যার প্রথম ধাপ হলো প্রাণিচিকিৎসা শিক্ষায় একটিমাত্র ডিগ্রি ‘ডিভিএম’ করা। প্রয়োজনে এই অভিন্ন ডিভিএম কোর্সের মেয়াদ বাড়িয়ে ৫ বছর ৬ মাস করা যেতে পারে।

যেহেতু উচ্চ মাধ্যমিকে আবেদনের যোগ্যতা অভিন্ন এবং কর্ম কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন করে প্রাথমিক বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই, সেহেতু প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো বাংলাদেশেও প্রাণিচিকিৎসা স্নাতকেরা সরাসরি কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারবেন। গত অর্ধশতকের পুরনো মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিরসনের মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভর জাতি বিনির্মাণ সম্ভব। এর কোনো বিকল্প জানা নেই।

লেখক: ডিভিএম, এমএস (মেডিসিন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।