সিজারিয়ানে বিড়ালির প্রাণ রক্ষা

সিজারিয়ান অপারেশন শেষে বিড়ালীটি। ছবি: লেখক

যখন অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলাম সেসময় ড. অনুপ কুমার তালুকদার ও ড. জীবন চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির কাজ শুরু হয়ে গেছে। জীবাণুমুক্ত সার্জিক্যাল এপ্রোন-মাস্ক-হ্যান্ড গ্লোবস পড়ে আমি ও ড. মো. আতাউর রহমান সার্জারিতে যোগ দিলাম। কিসের অপারেশন ছিল এটি? কেউ কি বলতে পারবেন? একটি বিড়ালের জীবন রক্ষার অপারেশন ছিল এটি!

অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে দেখলাম দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছেন বিড়ালটির মালিক মহিলাটি। তার দিকে তাকালে যে কেউ মনে করবেন যে তার কোন নিকটাত্মীয়ের অপরেশন চলছে। আসলেই তাই। বিড়ালটি যেন তার আত্মীয়ের থেকেও বেশি কিছু; তার আরেকটি মেয়ে, যার জন্য তিনি উদ্ভিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ত্রিশ বছর আগের কথা। তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) অর্থাৎ প্রাণীচিকিৎসার ছাত্র। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি ক্লিনিকে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন প্রাণীর নানা ধরনের সার্জারি করা হতো। কিছু প্রাণীপ্রেমী মানুষ তখনও দেখেছি। কিন্তু এই ত্রিশ বছরে এসব প্রাণীপ্রেমী মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে বহুগুণ তেমনি দেশে বেড়েছে ভেটেরিনারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ভেটেরিনারি চিকিৎসার মান। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় জেলা শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বেড়েছে, বিশেষ করে পোষাপ্রাণী অর্থাৎ কুকুর-বিড়াল-পাখির।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) ভেটেরিনারি টিচিং হসপিটাল (ভিটিএইচ) মাত্র দু-বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলত বশেমুরকৃবি-এর ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিভিএম শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রাণীচিকিৎসা শেখানোর জন্য। ভিটিএইচ-এ প্রাণীচিকিৎসার অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামসহ একদল অভিজ্ঞ ও তরুন প্রাণীচিকিৎসক রয়েছেন যারা ভবিষ্যৎ প্রাণীচিকিৎসক তৈরির পাশাপাশি প্রাণীচিকিৎসা সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

হসপিটালটির প্রথম পরিচালক হিসেবে আমি গত ৩০ জুন দু-বছর পূর্ণ করে বিদায় নিলাম। এই দু-বছরে আমরা বেশকিছু পোষাপ্রাণীর চিকিৎসা করেছি যার মধ্যে দেশি বিড়ালের সংখ্যাই ছিল বেশি। অবশ্য করোনা মহামারী না থাকলে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি হতো বলেই আমার বিশ্বাস। সম্প্রতি হসপিটালের অত্যাধুনিক এক্স-রে মেশিনের সাহায্যে বনবিভাগের সাতটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপের ডিম না পাড়ার কারণ উদঘাটনও করেছি আমরা।

প্রসববিঘ্ন বা ডিস্টোকিয়া মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রসবকালীন একটি জটিল সমস্যা। ফলে মা ও নবজাতক উভয়েরই মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে। তবে গবাদি ও অন্যান্য পোষা প্রাণীর তুলনায় বিড়ালে এ সমস্যা অনেক কম। দেশের বিভিন্ন ভেটেরিনারি বা প্রাণী চিকিৎসা হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিড়ালের বিভিন্ন রোগ চিকিৎসার তথ্য-উপাত্ত থেকে দেশি স্ত্রী বিড়াল অর্থাৎ বিড়ালীর জটিল প্রসববিঘ্ন সমস্যার ক্লিনিক্যাল কেইস রিপোর্ট কিংবা গবেষণালদ্ধ তথ্য তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাছাড়া এ বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকদের প্র্যাকটিসও সামান্যই। প্রসববিঘ্ন সমস্যা সমাধানে সচরাচর প্রথমে ওষুধ প্রয়োগ ও পরে অস্ত্রোপচারের সাহায্য ছাড়া হাতে বাচ্চা প্রসব করানোর চেষ্টা করা হয়। তবে এ পদ্ধতি ব্যর্থ হলে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারই শেষ ভরসা।

সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার সি-সেকশান বা সিজারিয়ান ডেলিভারি নামেও পরিচিত। এটি এক ধরনের শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে তলপেট ছেদনের মাধ্যমে মায়ের জঠর বা গর্ভ থেকে এক বা একাধিক বাচ্চা বের করে আনা হয়। এটি সচরাচর তখনই করা হয় যখন স্বাভাবিক উপায়ে যোনির মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত প্রসবকষ্ট, জমজ গর্ভাবস্থা, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভে বাচ্চা উল্টে থাকা, গর্ভফুল ও নাভিসংক্রান্ত সমস্যা ইত্যাদির কারণে সিজারিয়ান করা হয়। সিজারিয়ান রোমান শাসনামল থেকেই প্রচলিত। সে সময় এটি মৃত মায়ের গর্ভ থেকে জীবিত বাচ্চা উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।

 

শুরুতেই যা বলছিলাম, গাজীপুর জেলার সালনায় অবস্থিত বশেমুরকৃবির ভিটিএইচ-এর একদল বিশেষজ্ঞ প্রাণীচিকিৎসক সম্প্রতি জটিল প্রসববিঘ্নে আক্রান্ত বিড়ালীর প্রথম বাচ্চা প্রসবের ৩৬ ঘন্টা পর সিজারিয়ান করে তার জরায়ু থেকে দুটি মৃত বাচ্চা অপসারণ করে অবলা প্রাণীটির প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন। জানামতে, দেশি বিড়ালীতে আমাদের এই অপারেশনটি বিশ্বব্যাপী জটিল প্রসববিঘ্নের প্রথম সফল সিজারিয়ান অপারেশন যার ফলাফল ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভেটেরিনারি মেডিসিন এন্ড সাইন্স নামের একটি স্বনামধন্য গবেষণা সাময়িকীতে কেইস স্টাডি হিসেবে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে।

কেইস হিস্ট্রি নিয়ে দেখা যায়, বিড়ালীটি জরায়ুর অসাড়তার কারণে প্রসববিঘ্নে ভুগছিল। ফলে তার মালিক এটিকে স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জনের কাছে নিয়ে যান। সেখানে বিড়ালীটি একটি বাচ্চা প্রসব করলেও তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। কিন্তু এরপর ৩৬ ঘন্টা পার হলেও বিড়ালীটি আর কোন বাচ্চা প্রসব করেনি; তাছাড়া তার গর্ভফুলও আটকে ছিল। এমতাবস্থায় সে বেশ কষ্ট পাচ্ছিল, তাই স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জন বিড়ালীটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বশেমুরকৃবির ভিটিএইচ-এ নেয়ার পরামর্শ দেন।

আমাদের হসপিটালে আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষায় বিড়ালীটির জরায়ুতে আরও দুটি মৃত বাচ্চার অস্তিত্ব ধরা পড়ে যা আমরা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সফলভাবে বের করতে সক্ষম হই। এতে মৃতপ্রায় বিড়ালীটিও প্রাণে রক্ষা পায়। সিজারিয়ানের সময় জরায়ুতে পচন ধরার লক্ষণ দেখতে পাওয়ায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিড়ালীটির জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া হয়। তা না হলে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভবনা ছিল। প্রসববিঘেœর সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মৃত বাচ্চা বের করে মা বিড়ালটিকে প্রাণ বাঁচানোর বিশ্বব্যাপী এই প্রথম রেকর্ড নি:সন্দেহে আমাদের অন্যান্য সার্জারি কাজে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

প্রাণী পোষা মানুষের প্রাচীনকালের সহজাত বৈশিষ্ট্য। তবে এদেশে সার্বক্ষণিক পোষা প্রাণী হিসেবে ইতিপূর্বে মূলত বিদেশী জাতের কুকুর-বিড়ালই বেশি পোষা হতো। সেগুলোকে নিয়মিত টিকা প্রদান ও চিকিৎসা করা হতো। তবে আশার কথা বর্তমানে এদেশের মানুষের মধ্যে দেশি বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা, বিড়াল পোষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা যথেষ্ট বেড়েছে। এই পোষা প্রাণীগুলো রোগাক্রান্ত হলে ভেটেরিনারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে তারা একমুহুর্তও দেরি করে না। এদের টিকা প্রদান ও রোগ-চিকিৎসায় টাকা-পয়সা খরচ করতেও দ্বিধা করে না। বেঁচে থাকুন প্রাণীদের প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা চিরকাল।

লেখক: বন্যপ্রাণী বিষয়ক জীববিজ্ঞানী, প্রাণীচিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ।