সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও বিশ্বের বৃহত্তম ও অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বন, জলাভূমি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত এমন প্রাকৃতিক বন পৃথিবীতে দেখা যায় না। এই বন ডোরাকাটা বাঘের অন্যতম আবাসস্থল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঘের আবাসস্থল। ফলে আগামীতে এই বনে বাঘের অস্তিত্ব টিকে থাকা কঠিন হবে বলছেন বাঘ বিশেষজ্ঞরা। এদিকে চলমান জরিপেও বাঘের সংখ্যা নিয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে জরিপ দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এই ক্ষতি থেকে সুন্দরবনকে রক্ষায় দেশের উচ্চপর্যায় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুন্দরবনকে রক্ষায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। তা না হলে অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে টিকে থাকা দুশরও বেশি বাঘের অন্যতম এই আবাসস্থল হারিয়ে যেতে পারে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৭ সালে সিডরের পর সুন্দরবনে ৪০টি হরিণ, একটি বাঘ ও একটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০০৯-এ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর তিনটি হরিণ ও একটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ঝড়গুলোতে বাঘ, হরিণসহ অন্য কোনো বন্য প্রাণীর ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে চারটি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঘূণিঝড় রেমালে ১২৭টি মৃত হরিণ ও চারটি মৃত শূকরের মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। আর বুলবুল ও আম্ফানের চেয়ে রেমালের আঘাতে তিনগুণ বেশি গাছপালা, পশুপাখি, প্রাণী ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, যার ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ আছে ১১৪টি। এ সংখ্যা ২০১৫ সালের বাঘশুমারি থেকে আটটি বেশি। অন্যদিকে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে (পশ্চিমবঙ্গে) বাঘের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা অধিবেশনে রাজ্যের বন প্রতিমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা জানান, ২০১০ সালে এই রাজ্যের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭৪। ২০১৪ সালে বেড়ে হয় ৭৬। ২০১৮ সালে আরও বেড়ে হয় ৮৮টি। ২০১৯ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ ছিল ৯৬টি। আর ২০২২ সালে সর্বশেষ হিসাবে বাঘের সংখ্যা আরও বেড়ে হয়েছে ১০১।
গত বছরের নভেম্বর থেকে চলছে সু্ন্দরবনে বাঘ জরিপ। ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে’ আওতায় বনে বাঘ গণনার জন্য চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে ২৯৫টি গ্রিড বা পয়েন্টে ক্যামেরা বসানো হয়। এর আগে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জে বাঘ গণনার ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ শেষ করে বন বিভাগ।
শুমারি দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, এবার বাঘশুমারিতে আশারূপ ফলাফল মেলেনি। ২৯ জুলাই বাঘ জরিপের ফলাফল প্রকাশের কথা থাকলেও বর্তমান দেশের পরিস্থিতির কারণে শেষ মুহূর্তের ফলাফল বিশ্লেষণের কাজ শেষ করতে পারেননি বাঘ গবেষকরা। এই মুহূর্তে অ্যানালাইসিসের কাজ চলমান, যা শেষ করতে আরও এক মাস লাগতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ প্রফেসর এমএ আজিজ বলেন, সারা বিশ্বে বাঘের আবাস হিসেবে সু্ন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন মিলিয়ে যত বাঘ আছে, এটি বিশ্বে বাঘের অন্যতম সোর্স সাইটও। পৃথিবীতে বাঘ সংক্ষরণে এটি প্রায়োরিটি ল্যান্ডস্কেপ হিসেবেও স্বীকৃত। দুশর বেশি বন্য বাঘের ব্রিডিং সাইট হওয়াতে গ্লোবাল টাইগার কনজারভেশনে এটির গুরুত্বও অন্যতম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সবচেয়ে বেশি হুমকিতে বাঘের এই আবাসস্থল।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালে যত সংখ্যক হরিণ মারা গেছে, এর আগে এত বেশি মারা যাওয়ার ঘটনা কখনও ঘটেনি। সুন্দরবনকে রক্ষায় এখন দেশের উচ্চপর্যায় এবং আন্তর্জাতিক মাধ্যম থেকেও উদ্যোগ নিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় রেমালে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা আমরা জানি। যদি তাৎক্ষণিক একটা অ্যাসেসমেন্ট করা যেত, তাহলে জানা যেত ক্ষতির পরিমাণ কী। এটি ঝড় যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে করা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। তাই এই মুহূর্তে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের একটি অ্যাসেসমেন্ট খুবই জরুরি।
বুয়েটের জলবায়ুবিদ একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ শিকার বাংলাদেশ। সুন্দরবনে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। আগামীতে বনে লবণাক্ততা আরও বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জোয়ারের পানি বনে প্রবেশ করছে। এতে মাটি সরে যাওয়াতে ঝড়ে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত হতে পারছে না। আগেও সুন্দরবনে ঝড় হলে গাছ মারা যেত। কিন্তু এখন গাছ মারা যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বেশি। অথচ দৃশ্যমান কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা নেই। বাঁধ দিয়েও সুরক্ষিত করা হয়নি ম্যানগ্রোভ বনটিকে।