নীরব মৃত্যু: প্রকৃতিতে আর ফিরবে না প্রাণীগুলো!

দাবানলের আগুনে আহত প্রাণী। ছবি: সংগৃহীত

আগুনে পুড়ে মারা গেছে কয়েক কোটি প্রাণী, অনেক সরীসৃপস ও উদ্ভিদসহ নানা কীট-পতঙ্গ। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই দাবানলের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু বিপন্নপ্রায় প্রাণী। যাদের হয়তো আর প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা যাবে না।

গবেষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের স্বাভাবিকের চেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে ক্যাঙ্গারু দ্বীপের পশ্চিম অংশের নদীর পাশে। দ্বীপের বিরল ডাননার্ট- যা ক্ষুদ্র এক প্রকার ইঁদুর। যা অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও দেখা পাওয়া যায়না। কিছুদিন আগে ওই এলাকায় দুটি দাবানল ছড়িয়ে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় খুদে প্রাণিগুলো।

ক্যাঙ্গারু দ্বীপের পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা সংগঠন ‘ল্যাণ্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ’র একজন পরিবেশবিদ প্যাট হজেন্স। সম্প্রতি তার ক্যামেরাগুলোতে ধরা পড়ে ইঁদুরগুলোর পুড়ে মারা যাওয়ার চিত্র। এ বিষয়ে হজেন্স বলেন, দ্বীপের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রজাতিগুলো আবাস একেবারেই বিনষ্ট হয়েছে।

ডাননার্ট- ক্ষুদ্র এক প্রকার ইঁদুর। ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলে তিনটি দ্বীপে দাবানলের আগুন গ্রাস করেছে বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী। প্রাণীবিদরা বলছেন, পুড়ে মারা যাওয়া প্রাণীগুলোর প্রজাতি ফিরিয়ে আনতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। হেসটিং রিভার মাউসের ৪০ শতাংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চড়ুই জাতীয় রুফাস স্ক্রাব পাখির এক-তৃতীয়াংশ বিলুপ্তির পথে। নিয়ন্ত্রণহীন এই আগুনে আগামী কয়েক মাসে আরো অনেক প্রজাতি প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সারাহ লেগ বলেন, ক্যাঙ্গারু দ্বীপে যা ঘটেছে, তা অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলের ভয়াবহতার পূর্বাভাস। ‘বেশ কিছু’ বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের পুরো প্রজাতিটিই ধ্বংস হয়েছে। এখনো পর্যন্ত দাবানলে প্রায় ৬ কোটি হেক্টর বনাঞ্চল পুড়ে গেছে, যেগুলো যা বিশ্বে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যের জন্য সুপরিচিত ছিলো।

পরিবেশবাদিরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন এই দাবানল কয়েক দশক ধরে চলমান প্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কিছু প্রজাতিকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। যদিও জলবায়ু বিজ্ঞানীরা গ্রীন হাউজ গ্যাসের নি:সরণের কারণে প্রাণীর বিলুপ্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছিলো। পরিবেশবিদদের মতে, অস্ট্রেলিয়ার এই দাবানল পরিবেশ ধ্বংসের সূচনা মাত্র।

“এখন মনে হচ্ছে আমরা আগত ভবিষ্যতের একটি সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছি। যেখান থেকে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে, নয়তো এটি আমাদের দেশের মানচিত্র থেকে মুছে যাবে,” বলেন অধ্যাপক সারাহ লেগ।

গবেষকরা বলছেন, দাবানলের প্রভাব পড়ে প্রাণীদের খাদ্যচক্রেও। বহু প্রজাতির পাখি গাছের গুল্ম খেয়ে জীবনধারণ এবং বংশ বিস্তারে গাছে বাসা বেঁধে থাকে। দাবানলে গাছগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়াতে পাখিরা গাছে বাসাও বাঁধতে পারছেনা। অন্যদিকে লুকানোর মতো জায়গা খুঁজে পায়না পাখিরা। খোলা জায়গা বিচরণ করতে হয় বলে এই শিকারির হাতে মারা পড়তে হয় তাদের।

চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ওনারস্কি বলেন, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ও ক্যাঙ্গারু পালিয়ে আসছে। এতে ভাবার কোন কারণ নেই যে, তারা পালিয়ে বাঁচতে পারবে। কারণ আগুন একটু একটু করে পুরো এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে এগুলো আর পালানো জায়গা খুঁজে পাবে না। ওমব্যাট বাঁদুরগুলো হয়তো মাটির নিচে থাকার কারণে আগুন থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু এগুলো খাদ্যের অভাবে খুব শিগগিরই মারা যাবে।”

তিনি বলেন, “অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার সাথে এখানকার অধিবাসীরা পরিচিত। তবে কিছু অঞ্চল ছিলো যেখানে প্রাণীরা আগুনের থাবা থেকে নিরাপদ ছিলো। এই অঞ্চলগুলো আমাদের দেশের বন্যপ্রাণির সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে আসছিলো। কিন্তু এবারের দাবানল আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে বসাচ্ছে।”

“এই দাবানল প্রায় ঘটবে এবং আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে। কারণ জলবায়ু প্রভাবের কারণেই এমনটা ঘটছে। দাবানলের ছোবলে বহু প্রাণির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবু এই গ্রীষ্ম শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে,” বলেন ওনারস্কি।