ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ অঞ্চল। ভূমিরূপ উজান থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকার অনেকটারই অবস্থান উত্তর-পূর্ব থেকে উত্তর-দক্ষিণাংশে। এদিকটা ছোট বড় অসংখ্য ঢালু টিলা থেকে সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা। সেসব পাহাড়ি অঞ্চলে বহমান ছোট বড় বহু ঝিরি-ঝর্ণা।
পাহাড়ি অঞ্চলের তেমনই প্রাকৃতিক দু’টি ঝর্ণা বেশ পরিচিত, সিলেট বিভাগের মাধবকুণ্ড ঝর্ণা ও হাম হাম ঝর্ণা। যা দেশ-বিদেশের প্রকৃতিপ্রেমীদের নজর কেড়েছে বেশ। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বনবিট এলাকায় অবস্থিত প্রাকৃতিক জলের ঝর্ণা হাম হাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসফরে মাধকুণ্ড ঝর্ণা দেখা হলেও হাম হাম ঝর্ণা দেখা হয়নি এতদিন। যদিও আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল ঝর্ণাটি দর্শনের। তবে সময়-সুযোগ হয়ে উঠছিল না। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সুযোগ হয় ঝর্ণাটি দেখার। এ ঝর্ণাটি বাংলাদেশ-ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা।
জানা যায়, ২০১০ সালে একদল প্রকৃতিভ্রমণকারী রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গহীনের শেষাংশে ঝর্ণাটির প্রথম সন্ধান পান। এরপর সময় যত গড়িয়েছে এটি দর্শনে আসা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। গহীন বনের আকাবাঁকা, উচু-নিচু অন্তত আটটি পাহাড় পেরিয়ে ঝর্ণাটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। বেশিরভাগই বর্ষা, প্রাক-বর্ষা বা বর্ষার শেষদিকে আসেন বলে জানান স্থানীয়রা।
আমরা দশজন অভিযাত্রী যে সময়টিতে হাম হাম জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলাম, তখন শীতকাল হওয়ায় দিনের দৈর্ঘ্য কমে গিয়েছিল। তাই বনাঞ্চলে প্রবেশের নির্দিষ্ট সময় পার হওয়াতে শুরুতে অনুমতি মিলছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত দশ টাকা মূষক দিয়ে বনে প্রবেশের বিশেষ অনুমতি মিলল।
মৌখিকভাবে বলে দেওয়া হলো যেন সূর্য ডুবার আগেই যেন বন থেকে বেরিয়ে আসি। সূর্য ডুবতে বাকি তিন ঘন্টা। চলতি পথে ঝর্ণার কাছেই বিএসএফের লাগানো ভারতীয় সীমানা নির্ধারণী একটি সাইডবোর্ডও দেখা মিলেছিল। এরপর আর বিলম্ব না করে বনের ভিতরে পাহাড়ে উঠার জন্য একটি করে কচি বাঁশের লাঠি নিয়ে রওনা দিলাম।
প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠে আবার নিচে নামার সময় চোখে পড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের একটি ক্যাম্পের। দূর থেকে চোখের দৃষ্টি সীমানায় ছিল পার্শ্ববর্তী দেশটির ওই ক্যাম্পটি।
যতই পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নামছিলাম, ততই কমছিল তাপমাত্রা। আর পথও ক্রমেই পিচ্ছিল হচ্ছিল। তাই বেশ সর্তকতার সাথেই বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে নামছিলাম। এভাবে আরো ২০ মিনিট হাঁটার পর দেখা মিলল পাহাড়ি সেই ঝর্ণা। স্বচ্ছ ও খুবই ঠান্ডা পানি। আশপাশে বাঁশ ঝাড় আর ঝর্ণার খুব কাছাকাছি চলে আসায় খুব ঠান্ডাও করছিল শরীরে।
সঙ্গে থাকা গাইড আমাদের হাঁটার পথে ব্যস্ত রেখেছিল এ বনে চিতাবাঘের উপস্থিতির গল্প শুনিয়ে। যদিও পথে চিতাবাঘের কোনো অস্তিত্ব দেখতে পাইনি। তবে নাম না জানা অনেক পাখি, জঙ্গলি ফুলফল দেখতে পেয়েছি এ পথে। ঘন্টা দেড়েকর ভ্রমণ পথে ঝর্ণার কাছে আসতেই শরীরটা ক্লান্ত হলেও সৌন্দর্য দেখে নিমিষেই উড়ে গেল সকল ক্লান্তি।
তবে ঝর্ণা দেখতে যেয়ে একটি বিষয় খুব খারাপ লেগেছে দেখে। তা হলো ভ্রমণকারীদের অনেকেই সঙ্গে থাকা খাবারের প্যাকেটগুলো যততত্র ফেলে গেছে। এতে ঝর্ণা এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলেই মনে হলো। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতার জন্য কয়েকটি বোর্ডে লেখা ছিল কোথায় আবর্জনা ফেলতে হবে। কিন্তু অনেকেই সেই বিষয়টি যেন তোয়াক্কাই করেনি!
হাম হাম ঝর্ণার ধারে ২০ মিনিট সময় কাটানোর পর গাইড তাগাদা দিলেন ফিরে যাওয়ার। ফেরার পথে সূর্য ডুবে চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। ফ্লাশ লাইটের আলোতে পথ দেখে মোটামুটি দেড় ঘন্টার মধ্যেই বন সংলংগ্ন লোকালয়ে পৌঁছে যাই। শরীরে ক্লান্তিভাব চলে আসলেও সবুজ গহীন বনে এমন নৈসর্গিক ঝর্ণার সৌন্দর্যে মনে ফিরেছিল প্রশান্তি।