“হিল্লো মিলেবো জুমত যায় দে, জুমত যায় দে, যাদে যাদে পধত্তুন পিছ্যা ফিরি রিনি চায়, শস্য ফুলুন দেঘিনে বুক্কো তার জুড়ায়,” এটি চাকমা সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় একটি গান। সারা বছর পরিশ্রম শেষে পাহাড়ি তরুণীরা যখন জুম ক্ষেতের পাকা ফসল ঘরে তুলতে যায় যখন মনের আনন্দে জুম ঘরের মাচায় বসে জুম্ম তরুণ-তরুণীরা গানটি গেয়ে থাকে।
গানের বাংলা অর্থ হলো “পাহাড়ী মেয়েটি জুমে যায় রে, যেতে যেতে পথে পথে পিছন ফিরে চায়, পাকা শস্য দেখে তার বুকটা জুড়ায়।” জুমে বীজ বপনের পাঁচ মাস পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের পর ফলিত ফসল দেখে হাঁসি ফুটে ওঠে জুম চাষীদের মুখে। এ মৌসুমে জুম ক্ষেত থেকে ফসল ঘরে আনতে শুরু হয় উৎফুল্ল জুমিয়া নারী-পুরুষের। কিছু কিছু জুমিয়া ঘরে নবান্ন উৎসবের আয়োজনও শুরু হয় এ সময়ে।
চলতি বছর জুমের সোনালী ফসল ঘরে তুলতে পারায় জুম্ম নারী-পুরুষ ফিরে পেয়েছে মুখের হাসি। চোখে ফুটে উঠেছে আশার আলো। পাহাড়ে জুম ক্ষেতে পুরো নভেম্বর মাসজুড়েই ছিল পাকা ফসল ঘরে তোলার ভরা মৌসুম। এবার জুমিয়াদের ঘরে উঠেছে বহু পরিশ্রমের জুমের সেই সোনালী ফসল। নিজের ফলানো ফসল ঘরে তুলতে পেরে জুমিয়া নারী-পুরুষের মুখে ফুটেছে হাঁসি, চোখে আশার আলো ।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দবানের পাহাড়িদের জুম ক্ষেতে শেষ হয়েছে পাকা ধান কাটা। পাশাপাশি ছিল মারফা (পাহাড়ি শশা), ছিনারগুলা (পাহাড়ি মিষ্টিফল), বেগুন, ধানি মরিচ, ঢেড়ঁশ, কাকরোল, কুমড়াসহ ইত্যাদি ফসল তোলার কাজ। এরপর ঘরে উঠবে তিল, যব এবং সবশেষে তোলা হবে তুলা।
পাহাড়ি জুম চাষীরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল পরিষ্কার করে শুকানোর পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে জুম ক্ষেত্র প্রস্তুত করে । এরপর বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে পোড়া জুমের মাটিতে শুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুড়ে একসঙ্গে ধান তুলা, তিল কাউন, ভুট্টা, ফুটি চিনার, যব ইত্যাদি বীজ বপন করে। আষাঢ়-শ্রাবন মাসে জুমের ফসল পাওয়া শুরু হয়। সে সময় মারফা (পাহাড়ি শশা), কাঁচা মরিচ, চিনার ও ভুট্টা পাওয়া যায়। আর ধান পাকে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সব শেষে তুলা তিল, যব ঘরে তোলা হয় কার্ত্তিক-অগ্রহায়ন মাসে। চলতি বছর রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিনটি জেলার পাহাড়ে জুমের ভালো ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
রাঙামাটি সদররের মগবান ইউনিয়নের বৌদ্ধ চাকমা জুমের ফসল কাটতে কাটতে হাস্যেজ্বল মুখে বলেন, এবার জুম থেকে ভাল ধান মিলেছে। পাশাপাশি আমি হলুদ ও রোপন করেছি । মগবান ইউনিয়নের আরেক জুমচাষী ননাবি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, দেড় একরের মতো জায়গায় জুমচাষ করেছেন তিনি। এ জুমে উৎপাদিত ফসল দিয়ে আগামী ৭-৮ মাস পর্যন্ত তার খাদ্যের চাহিদা মিটবে। এছাড়া বিক্রি করেও বেশকিছু অর্থ উপার্জন হবে তার।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর রাঙামাটির দশ উপজেলায় ৫ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে জুম ধান চাষ হয়েছে। যা প্রতি হেক্টরে গড়ে ১ দশমিক ১৪ মেট্রিক টন জুম ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে লক্ষমাত্রা হিসেবে প্রায় ৬ হাজার ৭৯৪ মেট্রিক টন জুমের ধান উৎপাদন হবে বলে জানায় কৃষি বিভাগ। জুম ধানের মধ্যে রয়েছে উফশী আউশও স্থানীয় (জুম) আউশ।
সদর উপজেলার শুকরছড়ি এলাকার জুমচাষী স্মৃতি চাকমা জানান, জুমের ফসল ভাল হয়েছে। আগামীতে কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে তারা ধান ও অন্যান্য ফসলও ভালোভাবে রোপন করতে পারবেন। এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় জুমের ধান ভাল হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক পবন কুমার চাকমা বলেন, জুম চাষ পাহাড়ি জনগোষ্ঠির একটি ঐতিহ্য। পাহাড়ি জনগোষ্ঠির বেশিরভাগ মানুষ এই জুম চাষকে কেন্দ্র করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে।
“গত বছর জুম চাষ হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে। এতে প্রতি হেক্টর ১ দশমিক ৩ মেট্রিক টন চাল পেয়েছি। এ বছর জুমের ফলন অনেকটা ভালো। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ ভাগ জমিতে জুমের ধান প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জুম চাষ পদ্ধতিতে কিছু আধুনিক ধানের চাষ প্রচলন করেছে। যেসব পাহাড়ে জমির উর্বরতা ভালো সেসব জায়গায় জুম চাষ ভালো হয়েছে,” উল্লেখ করেন তিনি।
পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী জুম চাষ পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন ও জুম চাষীদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে একদিকে এ অঞ্চলের খাদ্যর ঘাটতির পূরণ হবে তেমনি জুমিয়াদের জীবনমান বৃদ্ধি পাবে বলে মত দিয়েছেন কৃষি গবেষকরা।