আগের দিন আমরা চারজন সোনাদিয়া আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার পৌছালাম। পরের দিন নাজিম আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। ভোরে নাজিমের ফোন কলে ঘুম ভাঙ্গলো। মাসুক, সাজন, রাকিব ও নাজিমসহ সকালের নাস্তা সেরে ফিশারি ঘাটের দিকে রওনা হলাম। সকাল ৮টায় ঘাট থেকে আমরা স্পিডবোটে উঠলাম। তখন সাগর পূর্ণ জোয়ারে ছিলো। হাঁসের চর ও খড়ির চরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
কালাদিয়া চরের কাছাকাছি পৌছার পর বাতাসের বেগ বেড়ে গেলো। স্পিডবোট চালক নূরুল আলম বললো, দুই চরে কাজ শেষ করে যখন কালাদিয়া ফিরবো তখন ভাটা শুরু হবে। যার কারণে গভীর সমুদ্র পথে কালাদিয়া চরে আসতে হবে। প্রচন্ড বাতাস থাকায় গভীর সমুদ্র পথ নিরাপদ হবে না। সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলে হাঁসের ও খড়ির চরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে বোট ঘুরিয়ে কালাদিয়া চরে রওনা হলাম।
ভাটায় চর জেগে উঠবে সকাল ১১টায়। সোনাদিয়া দ্বীপের চারিদিকে পানি আর পানি থৈ থৈ করছে। একমাত্র বেলাকদিয়া চর ছাড়া কোথাও কোন শুকনো জায়গা নেই। তাই আমরা বেলাকদিয়া চরে নামতে বাধ্য হলাম। বেশ কয়েক প্রজাতির স্যান্ডপাইপার ও গাঙচিলের ঝাঁক নজরে পড়লো। কিন্তু আমাদের সবার মাঝে স্পুনবিল স্যান্ডপাইপার বা চামুচঠোঁট চা-পাখি খোঁজার লোভ কাজ করছিলো।
কনকনে শীত ও ঠান্ডা বাতাসের মাঝে সূর্যের তাপ ছিলো আশীর্বাদের মতন। আমাদের আরো দুই ঘন্টা বেলাকদিয়া চরে থাকতে হবে। তাই যার যার মতো করে ছবি তুলছিলাম। এরই মধ্যে স্পিডবোটের চালক একটি সাপের দেখা পেল। আমাদের সবাইকে সাপের কাছে নিয়েও গেল। সাপের দেখা পেয়ে আমরা উত্তেজিত হলাম। অনবরত ক্যামেরার শাটার চলছিল। যেটি ছিল বিষধর হলুদ পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপ। ইংরেজি নাম: ইয়েলো-বিল্ড সী স্নেক/yellow-belied sea snake; বৈজ্ঞানিক নাম: বিভিজি পেলামিস প্লাতুরা/bvg Pelamis platura।
বাংলাদেশে ৯৬ প্রজাতির সাপের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২৯টি প্রজাতির সাপ বিষধর (যার অধিকাংশেরই চিকিৎসা এ দেশে নেই)। এর মধ্যে ১৩টি প্রজাতিই সামুদ্রিক সাপ। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে ইয়েলো-বিল্ড সী স্নেক বিষের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। এ সাপের পেটের রঙ হলুদ। দেহের উপরি ভাগ কালো। এরা থাকে সমুদ্রে। কালো দেহে অদ্ভুত হলুদের ছোঁয়া থাকায় এ সাপ দেখতে খুব সুন্দর। এরা হাইড্রোফিডে/Hydrophidae পরিবারভুক্ত।
সাপ বিশেষজ্ঞরা জানান, এটা মারাত্মক বিষাক্ত জাতের সাপ। সাপের পেটে উজ্জ্বল বর্ণের হলুদ ছড়িয়ে আছে। আছে লেজের দিকে অদ্ভুত পেঁচানো পেঁচানো দাগ। দেখলে মনে হয় সাইকেলের প্যাডেল। গায়ের উপরি ভাগ কালো নীল বর্ণ। এরা পানির তলদেশেই বেশি থাকে। প্রায় ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা ঘণ্টায় ৩ থেকে ৭.১ কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটে। সামনের দিক সংকুচিত শরীর করে লেজের সাহায্যে এগিয়ে যায়। এদের দৃষ্টিশক্তি কম। তাই তারা চলাচলের সময় মুখের চারপাশে উৎপাদিত কম্পন দিয়ে মাছের সন্ধান করে থাকে।
এই সাপের জন্য প্রয়োজন উষ্ণ পানির। তাই সাধারণত এরা প্রশান্ত ও ভারত সাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। হলুদ পেট সামুদ্রিক সাপ অধিক সমুদ্রপ্রেমী। উপকূলের চেয়ে গভীর সমুদ্রই এদের বেশি পছন্দ। এরা সমুদ্রের পানিতে একটানা আট ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারে। বছরে তিনবার বংশবিস্তার করে। তাই এদের সংখ্যা অনেক কম। প্রজনন ঋতুতে এরা কখনো কখনো সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে থেকে আলো ও তাপ উপভোগ করে। অধিকাংশ সাপই মাছ খায়, বিশেষ করে লম্বা বাইম, চিংড়ি ও পাইপ মাছ। আবার মাছের ডিমও খেয়ে থাকে।