প্রকৃতি বাঁচাতে কমাতে হবে জনসংখ্যা

১১ জুলাই ১৯৮৭ বিশ্বের জনসংখ্যা পাঁচশ কোটি পরিপূর্ণ হয়। তখনই শুরু হয় বিশ্বজনসংখ্যা দিবস পালনের তোড়জোড়। জটিল সব প্রক্রিয়া অতিক্রম করে ৯০ দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি সভায় চূড়ান্ত হয় দিবস পালন বিষয়টি। ইউএনডিপি’র গর্ভন্যান্স কাউন্সিল কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অতি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। জনসংখ্যার গুরুত্ব, সমস্যা, ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন চিন্তা করে প্রতিবছর সুনির্দ্রষ্টি প্রতিপাদ্য শ্লোগান নির্ধারণের মাধ্যমে ১৯৯০ সাল থেকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ৫০০ কোটি হওয়ার দিনটিকে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস।

১০০০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল ৪০ কোটি, ৭৫০ বছরে তা দ্বিগুণ হয়, এরপর থেকে জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১০০ বছরে দ্বিগুণ, পরে ৫০ বছরে, বর্তমানে মাত্র ৪০ বছরে দ্বিগুণীতক হারে বাড়ছে। ১৯৯৯ সালের ১৮ জুলাই সকাল ১.২৪ মিনিটে যে শিশু জন্মগ্রহণ করেছে সেই হয়েছে ৬০০ কোটিতম ব্যক্তি। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্মনেয়া শিশু হয়েছে পৃথিবীর ভাগ্যবান ৭৪০ কোটিতম মানুষ। বাড়ছে হু হু করে বাড়ছে।

জনবিস্ফোরণের অবস্থা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে এই সর্বংসহা ধরণী। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে যুক্ত হচ্ছে ২.৬ জন শিশু। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই সংখ্যা অনেক বেশী। ব্রাজিল, চিলি, কিউবা, ইরান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে সন্তান জন্মদানের বিষয়টিকে আলাদা অনুভূতির মধ্যে রেখেছে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আফ্রিকাও এবিষয়ে অনেক এগিয়ে। তবে ওখানে নানা কারণে মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার বাড়তি সংখ্যা কিছুটা গড়পড়তা।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলিতে জন্মহার অনেক কম। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে খুব বেশি পিছিয়ে নেই। জনসংখ্যা যোগানে বিশ্বপরিস্থিতিকে ভাডিক্কী করছে। প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার বছরে ২২ লাখ যুক্ত হয়ে যুক্ত দ্রুত লাখ সংখ্যাকে দ্রুত কোটিতে পরিণত করছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল নানামাত্রিক হিসাব নিকাশ করে পরিসংখ্যানে জানিয়েছে এই হারে বাড়লে ২০৫০ সালে আমরা প্রায় ২৩ কোটির ঘর অতিক্রম করবো।

আমরা একা নই। আমাদের প্রতিবেশীরা জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি হিসাবে বেশ তালে গুলে আছে। বলা হয় এই সময়ে ভারত হবে পৃথিবীর এক নম্বর রাষ্ট্র, জনসংখ্যার হিসাবে। বর্তমানের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন পিছিয়ে পড়বে, থাকবে দ্বিতীয় স্থানে। তাও তুলনামূলক অনেক কম জনসংখ্যার ভার বহন করবে। তাদের হবে ১৪০ কোটি আর ভারত সেটাকে নিয়ে যাবে ১৭০ কোটিতে। যুক্তরাষ্টকেও টপকাবে নাইজেরিয়া। এলোমেলো হয়ে যাবে জনসংখ্যা পরিস্থিতি।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কিছুটা ব্যক্তিক্রমধর্মী অবস্থান তৈরি করেছে। ১৯৭০ সাল থেকে প্রজনন হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে। সক্ষম দম্পতির মধ্যেও অপেক্ষাকৃত ধীরগতির সন্তান উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে পেরেছে। মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার সুফলভোগীদের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম।

জনসংখ্যা পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য কার্যক্রমে জোরালো ভূমিকা রাখার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ এসব বিষয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ রাখতে উল্লেখযোগ্যভাবে সক্ষম হওয়ায় ২০১০ সালেই মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। এখানে কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয় বিশ্বায়ানের বিষয়টি খুব ওতপ্রোতভাবেজড়িত। বর্তমান হিসাবে জন্মহার চলতে থাকলে ২০৫০ সালে পৃথিবী প্রায় এক হাজার কোটি মানুষের পদভারে ভারাক্রান্ত হবে।

পৃথিবীর ভৌগলিক আকার কিন্তু বাড়েনি বরং কমেছে। গাদাগাদি করে বাসস্থান ব্যবস্থা করলেও প্রভাব পরে মোট সম্পদের উপর। সীমিত সম্পদ সুষম বণ্টন করলেও তা হ্রাস পাচ্ছে। কিছু কিছু তো ইতিমধ্যেই নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে। বড় বিপর্যয় হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ, গ্রিন হাউজ অ্যাফেক্ট, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর। প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য যতই চিল্লাচিল্লী হোক, জনসচেতনা বৃদ্ধি হোক কিন্তু মানুষের খাদ্যচাহিদা যোগান দিতে গিয়ে প্রকৃতি ক্রমেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। মানুষের খাদ্য চাহিদা ও জীবনযাত্রার মান পর্যায়ক্রমে ক্রমাবনিতরফলে মানুষ শহরমুখী হবে। বলা হয়- ২০৫০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ শহরের বাসিন্দা হবে।

মাত্র ১০০ বছর আগে ১৯শ শতকে সারা পৃথিবীতে মাত্র ১২টি শহর ছির যেখানে বসবাস করতো প্রতিটিতে ১০ লাখ মানুষ। বর্তমানে ৪০০টির বেশি শহর রয়েছে যেখানে গড়পড়তা ১০ লাখ মানুষ বসবাস করে। প্রতিটিতে ১ কোটিরও অধিক মানুষ তাদের জীবনজীবিকা নির্বাহ করতে কায়ক্লেশে চলছে এমন শহরই আছে ১৯টি। অথচ ১৮শ শতকে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ শহরের কৃত্রিম হাওয়া বাতাস পানি পয়ঃনিষ্কাশনের মতো জটিল প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতো। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় এবং শহরকেন্দ্রীক জনস্রোত থাকায় তাঁদের সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য গোসল ব্যবস্থাই বড় চ্যালেঞ্জ।

জন্মগত মৌলিক অধিকারের অভাব বিষয়টি না হয় ধামাচাপা থাকল। সীমিত সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় যতটুকু অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। এর ফলেই উৎপত্তি যতসব অন্যায় অবিচার অবৈধতা। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে অহরহ, যততত্র। অসুস্থ হচ্ছে, অপুষ্টিতে ভুগছে, মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, ফল হচ্ছে পুরু সমাজের উপর বিরোপ প্রভাব। বর্তমান করোনাকালতো আরো ভয়াবহ। সাময়িক গ্রামমুখী হলেও পুরো পৃথিবী জুরে অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয় শহরকেন্দ্রীক। ফলাফল মানুষজনের শহর মুখ্যনতা।

দেশ রাষ্ট্র আর ধরণীর অন্যতম মূল উপাদান হলো জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পৃথিবীর মোট সম্পদ যেহেতু বাড়ছেনা। বরং কমছে সেখানে মানবজাতির সার্বিক কল্যাণেও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা সবকিছুর ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করতে হলে সংখ্যার দিকটিকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে। প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সচেতন, বলা উচিত অধিক সচেতন হলেই একে অন্যের পারস্পরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অপর্যাপ্ততা, অপ্রতুলতা, অতিরিক্ত শব্দসমূহ অভিধান থেকে উধাও হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও সামাজিক শিক্ষার প্রতি অনুরাগ জন্মাবে। পরিবর্তন আসবে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। দ্বন্দ্ব-বিবাদ ক্রমশ কমে আসবে। মানবসৃষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে নিরীহ এই ধরিত্রী। মানুষের সকল অগ্রগতি, উন্নতি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হবে পারিবারিক পরিকল্পনা। মানুষ বসবাসের জন্য নিরাপদ হবে আগামীর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের মূল্য উদ্দেশ্যও তাই।

টেকসই উন্নয়ন কর্মী, বাংলাদেশ।

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।