
ছেলেবেলা থেকেই কবুতর পুষতাম। দেশি কবুতরের সাথে বুনো কবুতরও একই বাক্সে উন্মুক্তভাবে পালতাম। বিভিন্ন পাখি খাঁচায় বন্দি করে পুষতাম। একবার একটি আহত মেছোবাঘকেও গ্রামবাসীর হাত থেকে উদ্ধার করে পুষেছিলাম। বাড়িতে ছোটোখাটো একটা চিড়িয়াখানা ছিল বললে অতুক্তি হবে না।
চাকুরী জীবনে এসে মেয়ের বায়নাতে বেশ কিছু কেস বার্ড কিনেছিলাম তারমধ্যে গ্রে প্যারট, সান কনোরি, লাভ বার্ডের মত পাখিও ছিল। এসব পাখি অনেক সময় মারা যেত তাই একটা আত্মদহনে ভুগতাম। এক সময় মনে হল- কেন পাখিগুলো আমার ভালোবাসার দায় সে বহন করবে? যেহেতু এগুলো কেসবার্ড তাই উন্মুক্ত করলে এরা বাঁচবে না তাই এগুলো বিলিয়ে দিলাম।
এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম এমন ব্যাবস্থা করবো যাতে বাসায়ই পাখি আসে। প্রথম প্রথম মেয়ে বেশ অখুশি ছিল। ওকে বোঝালাম যে কেন আমরা একটি পাখিকে বন্দী করে রাখবো? ধরো তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, তোমাকে যদি আমি খাঁচায় বন্দী করে রাখি কেমন লাগবে? অনেক বোঝানোর পর সে কিছুটা বুঝলো।
আমার বাসা উত্তরা-০৩ নম্বর সেক্টরে, এখানে বেশ কিছু গাছপালা আছে। বাসার সামনে অনেক টিয়া আছে তারমধ্যে একজোড়া টিয়াও এসে এসির পাশের এক ফাঁকে বাসা করে বাস করতো। টিয়াগুলো দিনের বেশিরভাগ সময়ই বারান্দার সামনে একটি গাছে বসে থাকে আর আমরা সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে টিয়া দেখি। এখন টিয়া দম্পতি ডিম পেরে তা দিচ্ছে।
কয়েকবছর আগে বারান্দায় একটি ফুলদানী উল্টোকরে বেঁধে দিয়েছিলাম। সেখানে একজোড়া চড়ুই এসে বাসা বাঁধলো। এখন নিয়মিত সেই ফুলদানীতে চড়ইগুলো ডিম বাচ্চা দিচ্ছে। এ বছর সেই চড়ুই এর একজোড়া বাচ্চা আবার অন্য একটি এসির এঙ্গেলের ভিতর ডিম বাচ্চা দিয়েছে। এখন আমার বাসায় মোট তিন জোড়া পাখি।
আমার মেয়ের সারাদিনের কাজ হল বই পড়া আর পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে পাখি দেখা আর ওদের সাথে ভাব করা। সে চড়াইদের নামও দিয়েছে এলেক্স এবং আলিসা। সবাই যখন বাচ্চার হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ তুলে দেয় আমি তুলে দিয়েছি মুক্ত পাখি।
ওদিকে, গ্রামের বাড়িতে কয়েক বছর আগে পাখি হত্যা বন্ধ করতে বেশ প্রচার করেছিলাম। কুমারখালির বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ডিজিটাল ব্যানার এবং গাছে গাছে কয়েকশো মাটির খুঁটি টাঙিয়ে ছিলাম, পাখির বাসা করে দেবার জন্য। এরপর আমার এলাকায় পাখি হত্যা একপ্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আমাদের বাড়িতেও বেশ কিছু মাটির খুঁটি টাঙিয়েছিলাম সেখানেও কিছু পাখি, মৌমাছি বাসা করেছিল। যেহেতু ওখানে পাখিদের জ্বালাতন হয়না তাই সেখানে অনেক পাখির আশ্রয়স্থলে রুপ নিয়েছে। কয়েকবছর আগে একজোড়া মেঘহও মাছরাঙা বাসা করেছিল তাদের বাচ্চা-কাচ্ছা হতে হতে এখন বেশ কয়েকজোড়া। পুকুর পাড়ে প্রতিবছর একজোড়া ছোট মাছরাঙা বাসা করে।
গত বছর গিয়ে দেখলাম কমলা দামাও গাছে বাসা করেছে। আর পুরা পুকুরটাতো এখন পাখিদের দখলে। বিরল কালো-বক, নিশিবক, সবুজ বক বা ছোট বক, ডাহুক, কানিবক, কুড়া ঈগল সহ বিভিন্ন পাখি প্রায় সবসময়ই থাকে। ডাহুকগুলো এমন সাহসী হয়ে উঠেছে যে খাবার নিয়ে ওরা এখন প্রায়ই পাড়ার মুরগীর সাথে মারামারি করে।
এছাড়া ঘুঘুগুলো তো মুরগীর মত উঠানে খাবার দিলে খাবার খায়। বুলবুলি, শালিক আর দোয়েলগুলো ঘরে ঢুকে ফল-মুল রাখলে এসে খেয়ে যায়। এনিয়ে বাবা মাঝে মাঝেই আমাকে বলে তোর কারণে বাড়িতে পাখির এত অত্যাচার। শুনে মনে মনে হাসি। গত বছর ঈদে বাড়িতে গেলে সকাল বেলায় দেখি কাঠঠোকরা তিনতলার জানালায় এসে ঠোকাচ্ছে, সুযোগ পেয়ে সেলফিও তুললাম।
মনে মনে ভাবলাম ওরা মনে হয় বুঝেছে যে আমাদের একজন বন্ধু এসেছে। আসলে ভালোবাসা আর নিরাপত্তা দিলে এমনিতেই পাখি আসবে। খাঁচায় বন্দী করে পোষার মত অমানবিক না হয়েও যে পাখিদের সঙ্গ পাওয়া যায়, আমার বাড়িই তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
লেখক: প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ।