গ্রামবাংলায় পূর্বপুরুষের একটি বাড়িতে থাকার সুবাদে গোসাপের সাথে আমার পরিচিতি অনেক ছোটবেলা থেকেই। বাড়িটি ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। কখনও বাড়ির উঠান থেকে হেঁটে বাগানের দিকে চলে যেতে কখনও বা পুকুর পাড়ে রোদ পোহাতে আবার পুকুরের জলে সাঁতরে যেতেও দেখেছি।
আকারে বিশাল, পুকুরপাড়ে দেখলে ছোটোখাটো কুমির মনে হতো, প্রথমে একদম ছোটবেলায় এটাকে আমি কুমির ভাবলেও পরে আমার ভুল ভাঙ্গানো হয় এবং আমি জানতে পারি এটির নাম গোসাপ। তবে একটা সময়ের পরে আর সচারাচর দেখতে পেতাম না, বলা যেতে পারে গত কয়েক বছরে একটাও দেখিনি, হয়ত ওই গ্রামের বাড়িতে কম যাতায়াত হতো সেই কারনে আবার চারদিকের পুকুর জঙ্গল সব নষ্ট হয়ে গেছে সেই কারনেও।
গত বছর কাজের সুবাদে দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি গ্রামে গিয়ে আবার এটি চোখে পড়ে বেশ কয়েকবার। সম্প্রতি ছবি তোলার সখের কারনে দক্ষিণ ২৪ পরগণার নরেন্দ্রপুর অঞ্চলের ‘Chintamani Kar Bird Sactuary (CKBS)’-এ যাই এবং আবারও এক ঝলকের জন্য গোসাপের দেখা পাই এবং এই প্রথমবার আমি এর ছবি তোলার সুযোগও পাই।
নামে সাপ শব্দটির উল্লেখ থাকলেও এটি সাপ নয়। এটি দেখতে বড় আকারের টিকটিকির মতো, তবে সাপের মতই এদের দ্বিখণ্ডিত জ্বিভ আছে। ত্বক সাধারণত অমসৃণ ও গায়ের রঙ সাধারণত ধুসর, কালো ও বাদামী হয়। এদের গোসাপ/গুঁইসাপ/বেঙ্গল মনিটর (Varanus bengalensis) নামে ডাকা হয়। এটি একটি উভয়চর প্রাণী, সরীসৃপের মত বুকে ভর দিয়ে স্থলে চলাফেরা করার পাশাপাশি এরা জলেও বিচরণ করে। তবে সাধারনত মাটির নিচে গর্ত করে বা অনেক সময় উইপোকার ডিবিতেও এরা বাসা বানিয়ে থাকে।
একটি গোসাপের শরীর প্রায়ে ১৭৫ সেন্টিমিটার অবধি লম্বা হতে পারে এবং লেজ প্রায়ে ৭৫ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে এবং ওজন প্রায় ৭.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত হাঁস ও মুরগির ডিম, হাঁস-মুরগির বাচ্চা, অন্যান্য ছোট পাখি বা পাখির বাচ্চা এদের মুল শিকার। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় এবং মাছও এরা শিকার করে থাকে। শিকারের জন্য এরা ঝোপঝাড়ের আড়ালে, এবং কচুরিপানার আড়ালে লুকিয়ে থাকে, অনেক সময় কৃষি জমিতেও লুকিয়ে থাকে।
এরা সাধারনত মানুষকে ভয়ই পায়, তবে অনেক সময় আত্মরক্ষার কারনে মানুষকে আক্রমনও করে থাকে। আদিবাসি অঞ্চলের মানুষ গোসাপ শিকার করে খেয়ে থাকে। এছাড়া গোসাপের চামড়া দিয়ে দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় ঢোল কাঁজিরা তৈরি করা হয়ে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা অঞ্চলে এটি বেশি দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় সারা ভারতেই এই প্রাণীটি দেখতে পাওয়া গেলেও, গোসাপের চামড়া অনেক দামি হওয়ার কারনে এই চামড়া দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ, ম্যানি ব্যাগ, বেল্ট তৈরি করা হয়, তাই কিছু অসাধু লোক গুঁইসাপ হত্যা করে চামড়া আহরণ করে। আবার কিছু লোক কবিরাজি ঔষধ তৈরির কাজে গুঁইসাপের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে।
উপজাতি ও সাঁওতাল সম্প্রদায় গুই সাপের মাংস খাওয়ার জন্যও ব্যাপকভাবে তারা প্রাণীটি হত্যা করে। এছারাও প্রজনন ক্ষেত্র এবং আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার কারনে বর্তমানে এই প্রাণীটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশেও গোসাপ দেখা যায়।
লেখক: আলোকচিত্রী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।