“আমার দুঃখগুলো কাছিমের মতো গুটি গুটি পায়ে আর এগোতে পারে না। আমার দু:খগুলো কাছিমের মতো, আমাকে ছাড়িয়ে আর এগোতে পারে না।”
কিন্তু আমি তো কাছিম নই, কচ্ছপ! তাই বলে দু:খের কোনো পার্থক্য নেই। আমি অর্থাৎ কচ্ছপ সাধারণত: পুকুর, নদী, বড় জলাশয় ও সমুদ্রে বসবাস করি (শুধুমাত্র সন্তানসম্ভবা হলে ডাঙায় যাই ডিম পাড়তে)। আমার পোশাকি নাম- “টার্টেল/Turtle”, আর আমার যে বোনরা ডাঙায় বা মাটিতে থাকে তাদের বলে কাছিম (পোশাকি নাম- টরটোইজ/Tortoise)। একবার তো জলে বেশিদূর নেমে গিয়েছিল বোনেরা, সাঁতার জানে না, তাই ডুবেই গিয়েছিল। সে কি ভয়ানক কান্ড!
আমার কিছু দিদিরা জন্মেছিল জলে, থাকতেও ভালোবাসতো নদী ও সমুদ্রের মোহনা অঞ্চলে কিন্তু বিয়ে হয়ে ডাঙায় চলে গেল; যদিও পুরোনো টান তো, তাই জলাশয়ের আশেপাশে স্থলাভাগে থাকে। আমার দিদিদের নাম “কাঠা বা তেরাপিন।“ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই পারো যে সব “কাছিম বা তেরাপিন” কচ্ছপ কিন্তু সব “কচ্ছপ” কাছিম বা তেরাপিন নয়!
তোমরা ভাবছো নিশ্চয়ই যে আমাদের ভাই নেই কেন? আসলে পৃথিবীর তাপমাত্রা এত বেড়ে গেছে যে ডিমের ভিতর বাচ্চার লিঙ্গ পুরুষে পরিণত হচ্ছে না। তাই আমার মা-জেঠিমারা খুব চিন্তায় আছে যে বংশের প্রদীপ দেওয়ার জন্য বোধহয় আর কাউকে পাওয়া যাবে না! সত্যিই আমরা অস্তিত্বসংকটে ভুগছি! জানো তোমাদের আমাদেরকে শ্রদ্ধা করা উচিত কারণ: আমরা দুনিয়ার সবথেকে প্রাচীন জীব, প্রায় ২০ কোটি বছর আগে থেকে আমাদের বসবাস, তখন অবশ্য জলাশয় ছিল না তাই সবাই আমরা স্থলচর ছিলাম। বিবর্তনের কারণে কিছু কচ্ছপের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণভাবে অভিযোজিত হয়ে সমুদ্রে বসবাসের উপযোগী হয়ে গেছে।
আমাদের বন্ধু কে ছিল বলো তো? ডাইনোসর! আমরা সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করতাম। মনে করলেই কিরকম নস্টালজিক লাগে। আরে তোমাদের তো খাদ্যতালিকাটা বলাই হয়নি। কী নেই সেখানে! সব আছে- লতাপাতা, পচা দেহ, মাছ, জেলিফিস, ক্যাকটাস, স্পঞ্জ, ঝিনুক, শামুক, হাঁস, কুমিরের বাচ্চা, ব্যাঙ, কেঁচো, পোকামাকড়, কচুরিপানা আরও কত কী। প্রধাণতঃ কাছিমরা তৃণভোজী, তবে আমাদের আবার আমিষ ছাড়া চলেই না। বেশিরভাগ কচ্ছপরা মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে পারে না কিন্তু আমরা স্বাদু জলের কচ্ছপরা হিস্ হিস্ শব্দ করি। আমাদের কারোরই শ্রবণ ইন্দ্রিয় নেই কিন্তু দৃষ্টিশক্তি প্রখর, রঙের বিভেদ করতে পারি।
এইবার মানুষের জীবনে আমাদের প্রভাব নিয়ে তোমাদের সাথে বরং আলোচনা করি। দক্ষিণ আমেরিকার উপকথা অনুযায়ী মনে করা হয়, বিশাল এক কচ্ছপ এই পৃথিবীকে বহন করে এনেছে। আবার আমার পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছি যে চীনদেশে “কোয়াই” নামক আমার এক দাদামশাই দেবতারূপে বিশ্বের সৃষ্টি করেছিলেন; চীনে তাই আমার পূর্বপুরুষদের “দীর্ঘায়ু, শক্তি ও সহনশীলতার” প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। প্রাচীন গ্রিক দেবতা “হার্মিসের” প্রতীক কচ্ছপ। এশিয়ান সভ্যতা (ইজিপ্ট) ছাড়াও আরব, ইউরোপিয়ান সভ্যতায় বাটি, থালা, আংটি, হার ইত্যাদি তৈরিতে কচ্ছপের উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকী কচ্ছপাকৃতি কেদারারও দেখা মেলে। তবে মহেঞ্জোদাড়োতে আমাদের শিকারের বিভিন্ন ছবি মুদ্রাতে ও পাথরের দেওয়ালে লক্ষ্য করা যায়।
বেশ এইবার সংস্কৃতিতে আমাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো। আমাদের কিছু প্রজাতিকে মানুষ খাদ্য হিসাবে গ্ৰহণ করে। যেমন- ফ্ল্যাপশেল টার্টল! তবে মাঝে মাঝে ধর্মীয় সংস্কারের কারণে “চোখওয়ালা কচ্ছপ” মারে না। এছাড়া আমাদের সাথে কিছু কিছু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ জড়িত। যেমন- হিন্দু ধর্মে কচ্ছপকে বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার “কূর্ম” হিসেবে পূজা করা হয়- যেখানে ভগবান বিষ্ণুর উপরের অংশে মানুষের রূপ ও নিচের অংশে কচ্ছপের রূপ! সেইজন্য অন্ধ্রপ্রদেশে “শ্রী কূর্মম মন্দিরও” আছে। পুরাণশাস্ত্র অনুযায়ী মনে করা হয় হাতি কচ্ছপের খোলসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এশিয়াতে “কেতুপাত পেনিউ” নারকেল গাছের পাতা থেকে উৎপন্ন হয় যা কচ্ছপাকৃতির, মূলতঃ মালয়ালম সংস্কৃতিতে এটি ভূত তাড়াতে কাজে লাগে।
শুধু ভারতবর্ষে নয়, প্রাচীন চীনেও ৫০০০ বছর আগে সুমেরিয়ান অঞ্চলে কচ্ছপের খোলস ভবিষ্যৎবাণী করার কাজে লাগত। এছাড়াও ফেংশুই মতানুযায়ী যে বাড়িতে কচ্ছপ থাকে, সৌভাগ্য নিয়ে আসে এবং সমস্ত প্রতিকূলতা, নেতিবাচকতা দূর করে বলে মনে করা হয়। বাড়িতে এবং কর্মক্ষেত্রে কচ্ছপ রাখলে অর্থের সমস্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ক্রিস্টাল, তামা, রুপো, লোহা বা মাটির কচ্ছপ মূর্তি বাড়িতে রাখলে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে স্বপ্ন পূরণ হতে দেখা যায়।
বিভিন্ন ধাতুর ও বিভিন্ন সংখ্যার কচ্ছপের মূর্তি এক একরকম অর্থ বহন করে। যেমন- একজোড়া রাখলে মিলমিশ ঘটাবে, মাটির কচ্ছপ শারীরিক রোগ দূর করবে, ধাতব মূর্তি সৌভাগ্য আনবে বাড়িতে ও কর্মস্থলে, পিতলের মূর্তি পরীক্ষার ভালো ফলের জন্য, ক্রিস্টালের মূর্তি আর্থিক সচ্ছলতার জন্য, বড়ো কচ্ছপের পিঠে ছোটো কচ্ছপ সন্তান আগমনের জন্য ইত্যাদি। তাই একবাটি জলে কচ্ছপের মূর্তি উত্তর দিকে করে রাখলে অবশ্যাম্ভাবী সৌভাগ্য বহন করে আনবে ।
কিন্তু এত সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করার পরও দেখা যায় ৪০ শতাংশ কচ্ছপ বিপন্ন বা অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে, বিগত ১০০ বছরে ১০টিরও বেশি প্রজাতিকে আমরা হারিয়েছি! আমাদের মাংস, রক্ত, হাড়, চর্বি, খোলস সবকিছু বিক্রি করা হয়। আমাদেরকে নির্বিচারে শিকার করা হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগে থেকে কারণ সুস্বাদু মাংস, কম মূল্যের সহজলভ্য তেল ও আমাদের দীর্ঘদিন উপোস করবার পরেও জীবিত থাকবার ক্ষমতার কারণে! এখনও তাই দক্ষিণপূর্ব ভারত ছাড়াও চীন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দরে আমাদের খুব কদর।
আনুমানিক ৩৪০টি প্রজাতির কচ্ছপ টিকে রয়েছে, যার মধ্যে ১১টি প্রজাতিকে মানুষ খায় ও চারটি প্রজাতি বিদেশে রপ্তানিতে ব্যবহার করা হয়। কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গে “যশ” সাইক্লোনের প্রভাবে সুন্দরবনে আমাদের বংশের অনেক তেরাপিনরা প্রাণ হারিয়েছে। শুধুমাত্র “২৩শে মে” বিশ্ব কচ্ছপ দিবস পালনের কোনো অর্থ নেই। তোমাদের অতিরিক্ত চাহিদা, চোরাশিকার, বাসস্থান সংকোচন, দূষণ, প্রজনন ক্ষেত্র নষ্টের ধ্বংসযজ্ঞে আমাদের সংরক্ষণ আজ বিপন্নতার মুখে, সেইজন্য তোমাদের কাছে শুধু একটাই আর্জি- প্রচলিত “কচ্ছপ-খরগোশের” গল্পের মতো বাস্তবিক লড়াইতে আমরা যেন জিতে যেতে পারি, এই সাহায্যটুকু শুধু করো!!!