বিশ্ব এখন কঠিন এক যুদ্ধে লড়ছে। মানুষের অস্তিত্ব বিনষ্ট করার মতো ভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবী। এর বাইরে নেই প্রাণীরাও। তবে বন্যপ্রাণীরা নিজেদের সীমানার মধ্যে খাবার পেলেও এর বাইরে যেসব প্রাণীর অবস্থান তারাও আজ মানবজাতির পাশাপাশি বিপর্যস্ত। এর কারণ অবশ্য আমরা মানুষেরাই।
নানা উপায়ে নিজ প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে আমরা এই পৃথিবীর প্রাণ বৈচিত্র্য নষ্ট করেছি এবং তা অব্যাহত রেখেছি। আমরা বুদ্ধিমান মানুষেরা একবারও ভাবিনি বা ভাববার সময় পাইনি ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ এসব প্রাণী কেন সৃষ্টি হয়েছে? আর জানলেও আমরা ভেবে নিয়েছি, তারা মানুষের জন্যই সৃষ্টি; নি:শেষ করে দিলেও কিচ্ছু হবে না। কারণ মানুষ সবই আবিষ্কার করতে পারে। অনেক শক্তিশালী আমরা মানুষেরা। কিন্তু না মানুষের চাইতে শক্তিশালী কিছু যে এই বিশ্বে আছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানবজাতি।
করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় এখন মানুষের পাশাপাশি বসবাস করা প্রাণীরাও সংকটে। কারণ দীর্ঘদিন মানুষের কাছ থেকে খাবার পেয়ে আসা প্রাণীগুলো এখন মানুষের খাদ্যের উৎসগুলো বন্ধ থাকায় অভুক্ত থাকছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণীরা হয়তো খাবার খুঁজে পেলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেটসহ আধুনিক হয়ে ওঠা শহরের প্রাণীগুলো না খেয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকছে।
এমন অবস্থায় সচেতন অনেক মানুষ প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা বা সদয় হয়ে খাবার দিয়েছেন এবং দিচ্ছেনও। তবে এই ভালোবাসার কারণে প্রাণীদের খাদ্য-শৃঙ্খল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। তাই খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।
গেল কিছুদিন ধরে ঢাকা বা বিভিন্ন শহরে অনেকেই অভুক্ত কুকুর, বিড়ালদের খাবার দিচ্ছেন। এটা একদিকে যেমন মানবিক অন্যদিকে বিশেষ প্রয়োজনীয়। প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, যুগের পর যুগ পথ কুকুর-বিড়াল মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে করতে এখন তারা মানুষের সমাজের একটি অংশ। দোকান-পাট, বাজার-হাট থেকে শুরু করে বাসা-বাড়ির ফেলে দেয়া খাবার ও ভালোবেসে মানুষের দেয়া খাবার তাদের এখন রিজিক।
কিন্তু যখন মানুষ আর পথে-ঘাটে নেই। তখন উপায় তো একটাই, নিস্তেজ হয়ে জীবনের শেষ দিনের অপেক্ষা করা। তবে না, মানবিক প্রাণী মানুষ তো এটা করতে পারে না। বিজ্ঞানও বলে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এসব প্রাণীদের। যারা মানুষের গড়ে তোলা নগরের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বাস্তসংস্থান সংরক্ষণে কাজ করছে। তাই তো অনেক সচেতন মানুষ প্রাণীদের খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে তৎপর হয়েছেন।
আমাদের ইট-পাথরের নগরীতে আরো প্রাণী আছে যারা মানুষের সমাজে থাকলেও নিজেদের মতোই বন্য স্বভাবে বিচরণ করে। যারা বনে না থাকলেও বন্যপ্রাণী; যেমন ঢাকায় টেরিটোরিয়াল বানর। যুগ যুগ ধরে যারা মানুষের সহবস্থানে বসবাস করছে। যাদের আবাস বা রাজত্ব বুড়িগঙ্গার তীরের গাছপালা, বাগান বা উদ্যান এবং বাড়ি-ঘরের ছাদে। প্রাচীন জনপদে মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা এই প্রাণীগুলোকে হেরিটেজ এনিমেলও বলা হয়। পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাড়ির গাছের কচি পাতা, ফল এবং মানুষের দেয়া বা ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে বেঁচে আছে বানরগুলো।
গত কিছুদিন ধরে কুকুর-বিড়ালদের খাবার দিতে এবং সংবাদ সংগ্রহে ছুটেছি রাজধানীর অনেক এলাকায়। পরিস্থিতি বর্ণনা করলে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকা বানরগুলো কুকুর বিড়ালের সাথে মারামারি করে খাবার থেকে দেখেছি। সারাদিন হা করে ডাস্টবিনের আশপাশে বসে থাকে প্রাণীগুলো। কারণ কে, কখন ময়লা ফেলবে আর কিছু খাবার খেতে পাবে এ আশায়…
এর মানে এতদিন মানুষের ওপর নির্ভরশীল ছিল বানরগুলো। আর এখন খাবার না পেলে মারাও যেতে পারে প্রাণীগুলো! পাশাপাশি ডাস্টবিনের আর্বজনা থেকে খাবার পেতে মরিয়া কুকুর-বিড়াল ও বানরগুলোর মধ্যে সংঘর্ষও চোখ এড়ায়নি। আরেকটি এলাকায় দেখলাম কুকুরদের দেয়া বনরুটি ছো মেরে নিয়ে গেল বানরের দল। আর গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো। এতেই পরিষ্কার পুরো বিষয়__ কুকুর-বিড়ালের পাশাপাশি ক্ষুধার্ত বানরগুলোও!
এমন পরিস্থিতি থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সংরক্ষণের নিয়ম বা আইনে কী আছে অলোচ্য বিষয় না। সরকার সবার জন্য বরাদ্দ করছে, ধনী-গরীব কোন ভেদাভেদ নাই, এখন সবাই সমান। কঠিন এ সময়ে প্রাণীগুলোকে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বৈধ কি অবৈধ বা ভালো কি মন্দ এটা দেশ খোলার পর দেখা যাবে… আর ততদিন পর্যন্ত প্রাণীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি এবং আমরা খাবার দিয়ে যাব। আমি মনে করি, বেঁচে থাকাটাই এখন জীবনের মূল চ্যালেঞ্জ। এই লক্ষ্যে আমি লড়াই বা যুদ্ধ চালিয়ে যাব।
তাই, এই সংকটে কুকুর-বিড়াল ও বানরকে নিয়মিত খাবার দিতে পরিকল্পনা নিই। এজন্য আমার প্রতিষ্ঠিত প্রাণী কল্যাণ সংগঠন ইকো সেভার্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করি। এতে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে ‘প’ ফাউন্ডেশনও। যাতে কাজে যেমন গতি এবং সমন্বয়ও দুই আসে। একইসঙ্গে ফেসবুক বন্ধুদের প্রতিও আহ্বান জানাই, যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবেশি প্রাণীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে।
বলে রাখা প্রয়োজন, যেহেতু বানর বন্যপ্রাণী তাই কয়েকজন বনপ্রাণী গবেষকের সঙ্গে আলাপ করি যে শহরে থাকা বন্য বানরদের খাবার দেয়া কতটা যুক্তিসংগত। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের আশপাশে বসবাসের কারণে বানরগুলোর খাদ্য-শৃঙ্খল বন্য পরিবেশের মতো আর নেই। মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবারের খেতে খেতে তারা এখন সবভোগী প্রাণী।
এতে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, বানরদের প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাবারই দিবো। যতই তারা বনরুটি, ভাত বা অন্য খাবার খেতে পারুক না কেন বানরের খাদ্য-শৃঙ্খল ক্ষতি হবে এমন খাবার দিব না। এ উদ্যোগে স্বশরীরে যুক্ত হন বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ ও অভিনয় শিল্পী ফারজানা রিক্তাও।
শুরু থেকেই কাওরান বাজারের ফলের আড়ত থেকে বানরদের জন্য কলা সংগ্রহ করছি। যাচাই বাছাই করে কেমিকেল মুক্ত কলা কেনা হয়। প্রথমদিন মিরপুর রোডে বানরের একটি দলকে কলা দিতেই জড়ো হয় বহু সংখ্যক বানর। সেখানে থাকা বানররেরে বাচ্চাগুলো গোগ্রাসে ১৫-২০টি কলা সাবাড় করে খেল…এতে আবারো ফুটে উঠে, কতটা হাহাকারে প্রাণীগুলো!
একইদিন গাড়িতে কলা নিয়ে রওনা হই আরেকটি এলাকায়। তখনো জানতাম না, সেখানে বানরদের দেখা পাব কিনা। আর যেহেতু অনেক এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে, তাই অনেকটা দু:চিন্তায়ও ছিলাম আমরা। তবে হঠাৎ গলির ভেতরে একটি বাড়ির কার্নিসে ফারজানা রিক্তা চোখে পড়লো একটি বানর। গাড়ি থেকে নেমে যেই হাতে কলাগুলো নিলাম অমনি ছুটে আসতে শুরু করে শত বানর। মনে হচ্ছিল, যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল বানরগুলো। আর বিধাতাও তাদের আকুতিতে সাড়া দিয়ে আমাদের পাঠিয়েছে খাবার দিয়ে… এরপর আর থেমে নেই, কুকুর-বিড়ালের পাশাপাশি ঢাকার বানরদের জন্য খাবার দেয়ার কাজটি চলমান রয়েছে।
লেখক: পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক, বাংলাদেশ
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।