পথটা যেতে হয় মেঘ-বৃষ্টির মধ্য দিয়ে…

মেঘ ও বৃষ্টি সঙ্গে ভূটানের অপরুপ পাহাড়ি পথ। ছবি: শুভদীপ অধিকারী

(পর্ব-০১) ভূটান দেশটার প্রতি আমার আকর্ষণ বহুদিনের। ইউনিভার্সিটির এক্সকারসানে গিয়ে প্রথম ফুন্টশিলিং আসি। তারপর আরো তিন বার। যদিও ফুন্টশিলিং থেকে একটু এগিয়ে যে মনাস্ট্রিটা আছে তা পেরিয়ে আর যাবার সুযোগ হয়নি। ডুয়ার্সে ঘুরতে এসে এই মনাস্ট্রিতে প্রচুর পর্যটক আসেন। এখানে আসতে পারমিট লাগে না। যদিও মনাস্ট্রির পরে যে চেকপোস্ট আছে সেখানে পারমিট চেক করে। এবার আমাদের ট্যুর পুরোটাই ভূটানে। তাই থিম্পু আর পারো ঘোরার জন্যে ফুন্টশিলিং থেকে পারমিট করাতে হয়।

ফুন্টশিলিং ভারতের সীমানা ঘেঁষা, অদ্ভুত সুন্দর পরিষ্কার পরিছন্ন একটা শহর। আর উল্টো পাশের ভারতীয় শহর জয়গাঁর কথা যত না বলা যায় ততই ভালো। সীমান্ত শহর হওয়ায় দুই দেশের সাধারণ মানুষদের যাতায়াতে বাধা নেই। ফুন্টশিলিং এর বহু দোকানি ভারতীয়। এমনকি বাংলাদেশের মানুষের সাথেও পরিচয় হয়েছে।

কর্মসূত্রে ভূটানে থাকেন এমন একজনের সাথে  ইমিগ্রেশন অফিসে বসে কথা হচ্ছিল। ওনার কাছ থেকে ওনাদের জীবনের নানা কথা শুনছিলাম। ভদ্রলোকের বাড়ি আলিপুরদুয়ারে। অন্যান্যরাও অধিকাংশই উত্তরবঙ্গের মানুষ। থিম্পুতে রঙের বা নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। ওখানেই থাকেন।

ফুন্টশিলিং থেকে থিম্পু আসার পুরো পথটাই পাহাড়ি। আসলে গোটা দেশটাই তো হিমালয়ের কোলে। জনসংখ্যাও খুব কম তাই দেশের বনাঞ্চলও সুরক্ষিত। এই দেশের একাত্তর শতাংশই বনভূমি। ফুন্টশিলিং পার হলেই পাহাড় আর জঙ্গলের রাজত্ব শুরু। পথে গাড়ির ভিড়ও তেমন নেই। টুরিস্টও বেশি না। আমাদের দার্জিলিং বা গ্যাংটকের তুলনায় তো নেহাতই নগন্য।

সবুজ পাহাড়ি এক অপরুপ প্রকৃতি। ছবি: শুভদীপ অধিকারী

এ বছরের ২৩ জুন, দক্ষিণবঙ্গ গরমে হাঁসফাঁস করছে, এদিকে আমাদের থিম্পু আসার গোটা পথটাই যেতে হয় মেঘ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। পাহাড়ি রাস্তায় এটা খুবই পরিচিত ব্যাপার। খুব তাড়াতাড়ি মেঘ এসে সামনের পাহাড়কে ঢেকে দেয়, তখন অল্প দূরের কোনো কিছুই দেখা যায়না। আবার কিছুক্ষণ পরেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে মেঘ কেটে গিয়ে অল্প রোদের দেখা মেলে। পাহাড়ে নিরন্তর রোদ, মেঘ, বৃষ্টির খেলা চলতেই থাকে। জানলার পাশে বসে সে দৃশ্য উপভোগ করার মধ্যে একটা অপার্থিব আনন্দ আছে।

পথে ভূটানের পাহাড়ের এক এক রূপ দেখলাম কোথাও পুরো জঙ্গলে ঢাকা, কোথাও বা গাছ তেমন নেই শুধু ঘাস বা ঝোপের উপস্থিতি। পাথুরে পাহাড়ও আছে। পাহাড়ের পাশে পাশে হাত ধরে চলেছে ছোট পাহাড়ি নদী। পথে চুখা পেরিয়ে এসেছি। সেখানেই আছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ফুন্টশিলিং থেকে থিম্পু প্রায় দেড়শো কিলোমিটারের রাস্তায় কিছু ছোট ছোট শহর আছে। সেই জায়গাটুকু বাদ দিলে মানুষের প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপের চিহ্নমাত্র নেই। প্রকৃতির অকৃপণ দানে সবুজে মোড়া ল্যান্ডস্কেপ।

ভারতের মতন জনবহুল দেশে হিমালয়ের সৌন্দর্য অনেকখানি ম্লান করে দেয় প্রকৃতির উপর মানুষের হস্তক্ষেপ। কিন্তু এখানে রাস্তার প্রতিটি বাঁকে আমাদের সামনে প্রকৃতি নতুন ভাবে ধরা দিয়েছে। পথের ধারে খাড়া পাথরের ঢালে সবুজের বুক চিরে কোথাও নেমে এসেছে জলের ধারা। সেখানে টুরিস্টদের কোনো ভিড় নেই। আপন খেয়ালে জলের ধারা রাস্তা ধুইয়ে নেমে গেছে খাদের দিকে। পথের ধারের স্কুল কলেজও অপূর্ব সুন্দর আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। স্বচ্ছতার জন্যে বিজ্ঞাপন দিতে হয়না এই দেশের মানুষকে।

ভূটানের পাহাড় ও ঝর্ণা। ছবি: শুভদীপ অধিকারী

তবে আমাদের মতন অসভ্য টুরিস্টদের মনে করিয়ে দেবার জন্যে রাস্তার ধারে বোর্ডে জায়গায় জায়গায় লেখা আছে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার কথা, আবর্জনা ফেললে শাস্তি দেবার কথা ইত্যাদি। সত্যিই গোটা রাস্তার এক জায়গাতেও আবর্জনার স্তূপ ছড়িয়ে থাকতে দেখিনি। সর্বত্র এখনকার অধিবাসীদের মূল্যবোধ আর শৃঙ্খলা বিস্মিত করে।

থিম্পুর প্রবেশ তোরণ পেরোনোর একটু আগে থেকেই বাইরের দৃশ্য আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে। বিচ্ছিন্ন ভাবে মানুষের বসতি চোখে পড়ে। এখনকার বাড়ি গুলো সাবেকি ট্র্যাডিশন মেনে তৈরি করতে হয়। অবশ্যই সামর্থ অনুযায়ী মালিক তা তৈরি করেন কিন্তু মূল প্যাটার্নটা মোটামুটি এক। থিম্পু ছু এর ধারে কিছুটা সমতল জায়গায় বা পাহাড়ের ধাপ কেটে চাষবাসের জমি দেখা যায়।

এই দেশে ভারত থেকে ফুলকপি, লঙ্কা, বিনস আর আলু নিয়ে আসায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। কারণ আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। যদিও এদেশের দোকান বাজারে ভারতীয় পণ্যের উপস্থিতি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। ভূটানে এখন অর্গানিক ফার্মিং-এর উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দুপুরে যেখানে লাঞ্চ করেছিলাম সেই হোটেলের মালিক বলছিলেন যে হোটেলে নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়। খাবারের বিষয়ে কোনো রকম আইনবিরুদ্ধ কাজ করলেই শাস্তি অনিবার্য। ভেবে আশ্চর্য হই যে আমরা ভারতীয়রা এখনও এই ব্যাপারে কতটা পিছিয়ে।

থিম্পুর কাছাকাছি আর একটা জিনিষ চোখে পড়লো তা হলো বিরাট জায়গা জুড়ে ছোট ছোট অনেক কাঠের মিল। বাড়ি আর আসবাবপত্র তৈরির কাঠের যোগান দিতে কাঠের বিমের সারি। থিম্পু অনেক ছোট শহর, অনেক ফাঁকা জায়গা। এখনকার জনসংখ্যা আমাদের হুগলি জেলার জনসংখ্যার প্রায় সাত ভাগের একভাগ। তবুও লোক সংখ্যা বাড়ছে। অনেক নতুন নতুন বাড়িঘর হচ্ছে। তার জন্যে দরকার নির্মাণ সামগ্রী, কাঠ, বাঁশ। এক জায়গায় ইটের নাম দেখলাম ইন্ডিয়া। ভারত থেকে আমদানি করাও হতে পারে। আসার পথে সিমেন্টের কারখানা চোখে পড়লেও ইটভাটা দেখতে পাইনি। ভয় হয় সভ্যতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে থিম্পু যাতে দার্জিলিং বা সিমলা না হয়ে যায়।

লেখক:গবেষক ও শিক্ষক, ভারত

চলবে… (দ্বিতীয় পর্ব- আগামীকাল)