বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম বুনোহাঁস

বাইক্কা বিলে একঝাঁক বালিহাঁস। ছবিগুলো তুলেছেন: লেখক

শ্বেতশুভ্র ছোট্ট হাঁস দুটিকে প্রথম দেখি ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরের শেষে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামে। কম বয়েসি ছোট হাঁস দুটির প্রথম দর্শনে খুব মায়া লেগেছিল। কেমন কাজলটানা মায়াবি চোখ… শীতের সকালে একদিন ফকিরহাট বাজারে এক পাখি বিক্রেতার কাছে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির সঙ্গে সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক এই হাঁস দুটিকেও বিক্রি করতে দেখলাম। আঁতকে ওঠলাম! মনটা খারাপ হয়ে গেল।

শেষটায় সামলে নিয়ে পাখি বিক্রেতার কাছ থেকে হাঁস দুটিকে কিনে সাতশৈয়া গ্রামে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। বহুদিন পর ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারিতে ওদের দেখলাম শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে। এরাই বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম বুনোহাঁস বালি হাঁস। বেলে হাঁস, ভূলিয়া হাঁস, তুলো হাঁস বা দীঘৌচ নামেও পরিচিত। বাগেরহাট এলাকায় এদেরকে বলে ভেড়ার কোট বা ভেড়ার ঢোঁশ।

ইংরেজি নাম Cotton Pygmy-goose, Cotton Teal, Common Teal, White-bodied Goose Teal বা Quaki Duck)। বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus coromandelianus (Gmelin, 1789) [নেট্টাপাস করম্যান্ডেলিয়ানাস (জেমেলিন, ১৭৮৯)

প্রাকৃতিকভাবে এদেরকে ভুটান ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন, ইন্দেনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ উত্তর ও পশ্চিম এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে দেখা যায়। ভেড়ার কোটের দেহের দৈর্ঘ্য ৩২-৩৪ সেমি ও প্রসারিত ডানা ৫৭ সেমি। ওজনে হাঁসা ২৫০-৩০০ গ্রাম ও হাঁসি ১৮০-২৮০ গ্রাম। হাঁসা ও হাঁসির চেহারায় পার্থক্য রয়েছে। হাঁসার মাথার চাঁদি ও পিঠ নীলাভ-কালো; চিবুক, গলা, ঘাড় ও দেহের নিচটা তুলোর মতো সাদা।

গলায় কালো মালা ও ডানায় সাদা ডোরা দেখা যায়। হাঁসার চোখ লালচে-বাদামি ও চঞ্চু কালো। অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল হাঁসির দেহের নিচটা অনুজ্জ্বল ফিকে সাদা, ডানার প্রান্ত সাদা, চোখ বরাবর কালো কাজলের মতো চক্ষু রেখা। চোখ বাদামি ও চঞ্চু কালচে-জলপাই বাদামি। হাঁসা-হাঁসি নির্বিশেষে পা ও পায়ের পাতা কালচে-বাদামি বা কালো। অপ্রাপ্তবয়ষ্ক পাখি দেখতে অনেকটা হাঁসির মতো, তবে চক্ষু রেখা প্রশস্ত। তাছাড়া দেহতলের রঙেও কিছুটা পার্থক্য থাকে।


ভেড়ার কোট জলজ উদ্ভিদভরা হ্রদ, হাওর, বিল, বড় পুকুর ইত্যাদিতে বিচরণ করে। সচরাচর ৫-১৫টির দলে দেখা যায়। পানিতে ভাসমান জলজ উদ্ভিদের কচি অংশ, শস্যবীজ, কীটপতঙ্গ ও এদের শুককীট, চিংড়ি ও কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী, ছোট মাছ ইত্যাদি খায়। পত পত শব্দে ডানা ঝাপটে দ্রুত উড়ে চলে যায়। ‘গ্যাহ-গ্যাগি-গ্যাহ—-’ বা ‘কুওয়াক-কুওয়াক-কুওয়াক—-’ শব্দে ডাকে।

জুন থেকে সেপ্টেম্বরে প্রজননকালে সচরাচর পানির ধারেকাছে মরা গাছের কোটরে-ফোকরে বাসা করে। তবে বর্তমানে গাছের অভাবে মানুষের বানানো কৃত্রিম বাসায়ও ডিম পাড়তে দেখা যায়, যেমন- বাইক্কা বিলে এদের জন্য যে কাঠের বাসা বানানো হয়েছে তাতে ফি বছর ডিম-বাচ্চা তুলছে। হাঁসি ছয়-বারটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে ও একাই ডিমে তা দেয়। হাঁসা ডিমে তা না দিলেও বাসা পাহাড়া দেয়। ডিম ফোটে ২২-২৪ দিনে। ছানারা বেশ ইঁচড়েপাকা হয়। ডিম থেকে ফোটার ১২-১৪ ঘন্টার মধ্যেই বাসা থেকে লাফিয়ে পানিতে নেমে যায়। আয়ুষ্কাল প্রায় সাত বছর।

লেখক: অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান, বন্যপ্রাণী ও পাখি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ।