
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছি, আন্ত:নগর পারাবত এক্সপ্রেসে। হঠাৎ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাইরে, ট্রেন ভ্রমণে এই কাজটাই সবচেয়ে আনন্দ নিয়ে করি। চমকে উঠলাম, আশ্চর্য সুন্দর এক পৃথিবীতে চলে এসেছি। এই অচেনা রাজ্যে ঘন গাছপালার ঠাসবুনোট। হাত দশেক দূরে একটা গাছ ভেঙে কাৎ হয়ে আছে আরেকটার ওপর।
এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে যাচ্ছে পাখি। ওদের সঙ্গে সমান তালে ডাকছে পোকামাকড়েরা। নেই কোনো শব্দ ও লোকজনের বিরক্তিকর কোলাহল। যতটা সময় ট্রেনটা দাঁড়িয়ে ছিল মোহচ্ছন্ন হয়েছিলাম, তারপর আবার যখন যেমন হঠাৎ থেমে ছিল তেমন আচমকা ছেড়ে দিল, তখনই বাস্তবে ফিরলাম।
ঘটনাটা বহু আগের, এইচএসসি পাশের পর সিলেট যাচ্ছিলাম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ঢাকা ফিরে আসার পর জানতে পারি ওটাই লাউয়াছড়া। জঙ্গলের প্রতি টানটা বহু আগ থেকে, এমনকী স্কুলে পড়ার সময় ফটিকছড়ির গভীর জঙ্গলে বেশ ঘুরাফেরাও হয়েছিল। তারপরও জঙ্গলদর্শনের তথা অরণ্যে ঘুরাফেরার আগ্রহটা মাথাচাড়া দিয়ে তুলতে লাউয়াছড়ায় এই ক্ষনিকের যাত্রাবিরতি দারুন ভূমিকা রাখে। আমার প্রিয় অরণ্যের তালিকায় লাউয়াছড়া প্রথম দিকে না থাকলেও আমি বনটির প্রতি কৃতজ্ঞ।
তবে এন্ডরসন-করবেট, বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহ, পচাব্দী গাজী, এনায়েত মাওলা ও আব্দুর রহমান চৌধুরীরাও আমার অরণ্যপ্রেম অনেকই বাড়িয়েছে। তবে পুরনো ওই সব বই যখনই পড়ি মনটা কাঁদে। আহ ষাট-সত্তর বছর আগে জন্মালে আঁশ মিটিয়ে দেখতে পারতাম পার্বত্য চট্টগ্রাম-সিলেট-কক্সবাজার কিংবা মধুপুরের অরণ্যকে।
তারপরও মনে কষ্ট নিয়েই জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি, আর আফসোস করেছি আহ্ এভাবে বনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের! তবে এই কিছুদিন ধরে বুকে যন্ত্রনাটা বড় বেশি। নিজে ঘুরে বেড়াবার সময় দেখার পাশাপাশি পরিচিত অরণ্যপ্রেমী ভাইরা যখন পাহাড়ের জঙ্গল সাফ করার ভয়াবহ সব কাহিনী বর্ণনা করে, ছবি দেখায় তখন নিজেক নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হয়।
কির্সতং-রুংরাংয়ে দেদার কাটা পড়ছে বিশাল সব মহীরুহ, আন্ধারমানিকের আশপাশে কাঠুরেদের কুঠারের আঘাতে রক্তাক্ত (মনের চোখে দেখতে পাবেন এটা অরণ্যপ্রেমীরা) বৃক্ষসারি, আলীকদমে ঝিরি থেকে মাটি-পাথর তুলার চিৎ সব কিছুই বুকে এসে বিঁধে। অরণ্য না থাকলে প্রিয় বুনো প্রাণরাও যে থাকবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘ দেখার স্বপ্ন তাই ক্রমেই ফিকে হতে থাকে! আবার অল্প-বিস্তর যা কিছু চিতা বাঘ, সম্বার কিংবা বাইসন আছে এখনো পাহাড়ে সেগুলোর ভবিষ্যত ভেবে চোখে আঁধার দেখি।
লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশ।