বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করে ফের বাঁচালো সুন্দরবন

পাখির চোখে সুন্দরবন। ছবি: জাকারিয়া পারভেজ, বাংলাদেশ

সুন্দরবন যেন এক মমতাময়ী মায়ের অসাধারণ প্রতিমূর্তি। অসংখ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঢাল হয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলকে বছরের পর বছর আগলে রাখছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটি। এরই ধারাবাহিকতায় শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আম্পান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এ সময় তীব্র বাতাস, ভারী বৃষ্টিপাত ও উঁচু জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূলজুড়ে তাণ্ডব চালায় আম্পান।

সাতক্ষীরা থেকে পটুয়াখালী উপকূল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব ছিল সবচে বেশি। বুধবার রাত নয়টায় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার গতিবেগে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত করে। এ সময় ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ছিল। এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপে প্রথম আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়টি। সুন্দরবন দিয়ে অতিক্রম করার কারণে আম্পানের তাণ্ডব কিছুটা কম হয়েছে।

ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডব। ছবি: কাজী শামীম হাসান, বাংলাদেশ

সাইক্লোন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো তথ্যমতে, সমুদ্রের প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার জুড়ে ছিল ঘূর্ণিঝড়টির বিস্তৃতি। আঘাতের লক্ষ্যবস্তু ছিল ভারত ও বাংলাদেশের বিশাল উপকূল। বাতাসের গতি কিংবা ঢেউয়ের তীব্রতায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান ছিল সুপার সাইক্লোন। তবে এত শক্তির পরও আম্পানকেও হার মানতে হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের কাছে। তাই আবারো উঠে এলো সুন্দরবন সংরক্ষণের আহ্বান।

একসঙ্গে বিশাল উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তৃতি এর আগে দেখেনি কেউ। আঘাত হানা অনেক সময় পরও শক্তি ধরে রাখার নতুন নজির সৃষ্টি করেছে সুপার সাইক্লোন আম্পান। দীর্ঘদিন ধরে দেশের দুর্যোগ নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. বিশ্বজিৎ নাথ। তার মতে, বঙ্গোপসাগরের ইতিহাসে আম্পান একটি বিরল ঘূর্ণিঝড়। যা দীর্ঘসময় ধরে প্রভাব বিস্তার করেছে বিশাল এলাকাজুড়ে। আম্পানের বিস্তৃত অন্যান্য ঝড়ের থেকেও বেশি ছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শক্তিশালী ও প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানকে শুধু বুক পেতে সহ্য করার পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধও করেছে সুন্দরবন। যা বাংলাদেশমুখী ঝড়টির গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে দুর্বলও করেছে। ফলে বড় দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে এ দেশ।

ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডব। ছবি: কাজী শামীম হাসান, বাংলাদেশ

”বাংলাদেশে বিভিন্ন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে, এ কারণে অভ্যন্তরীণ গঠন পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। এই পরিবর্তন হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতিপথও পরিবর্তন হতে বাধ্য,” বলেন ড. বিশ্বজিৎ নাথ। বাংলাদেশের সামুদ্রিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের দিকে নিম্নচাপ থাকায় সেদিকে আকৃষ্ট হয়ে দুর্বল হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়টি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আম্পান বিদায় নিলেও আগামীতে এ অঞ্চলে আরো বড় দুর্যোগের আভাস দিয়ে গেছে। বুয়েটের জলবায়ুবিদ ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, আগামীতে ক্যাটাগরি ৪ এবং ৫ সাইক্লোনের শঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। ভবিষতে সাইক্লোন আরো শক্তিশালী ও বৃষ্টিপাত নিয়ে হবে। সুন্দরবন বার বার উপকূলকে রক্ষা করলেও ঝড়ের পরে বনটিকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বিপদ বাড়াচ্ছে। তাই উপকূল জুড়ে অনেকগুলো সুন্দরবনের রূপ দিতে হবে।

ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডব। ছবি: কাজী শামীম হাসান, বাংলাদেশ

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়টির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র সর্বোচ্চ গতি ২২৩ কি.মি। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয় ঘণ্টায় ২৪৫ কি.মি। তবে এই গতি কমে আসতে প্রাকৃতিক বন সুন্দরবন অনেকটা ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। বনভূমি ও গাছপালা শক্ত প্রতিরোধে কমে যায় ঘূর্ণিঝড়টির তীব্রতা।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৭ মে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় আইলা, এমনকি ২০১৯ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল থেকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। তাই নয় যুগের পর যুগ বনটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করছে উপকূলকে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের চোখের আয়তন ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কা লাগত খোদ রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার কমে গিয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র সামনেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ম্যানগ্রোভ বনটি।

সমীক্ষা বলছে, সুন্দরবনের কারণে আইলার গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা চার ফুট কমে গিয়েছিল। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে এই বনের ৪০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আজও লড়াই করে যাচ্ছে সুন্দরবন। এমন করে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে বাঁধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনটি। নিজে ক্ষতবিক্ষত ও অসংখ্য উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনের বিনিময়ে রক্ষা পায় উপকূলের লক্ষাধিক মানুষ।

সুন্দরবন ও বন্যপ্রাণী গবেষক নাসির উদ্দিন বলেন, সুন্দরবন ভারত ও বাংলাদেশ অংশের মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি প্রাকৃতিক দেয়াল। আইলা, সিডর, বুলবুল এবং সর্বোপরি আম্পানের মত বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুন্দরবন তার উপকুলের বাসিন্দাদের রক্ষা করেছে।

সুন্দরবন, বাংলাদেশ। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

”সুন্দরবনের মত উপকূলীয় বেষ্টনী যাতে চিরদিন মানুষের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এ বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। মা যেমন সন্তানদের আগলে রাখে তেমনি সুন্দরবন উপকূলের বাসিন্দাদেরও আগলে রাখে। কাজেই আমাদেরকেও সুন্দরবনের নিরাপত্তার জন্য উদ্যোগী হতে হবে,” উল্লেখ করেন গবেষক নাসির উদ্দিন।

বৈশ্বিক ঝড় নির্ণয়ক বিখ্যাত সংস্থা আকুওয়েদার ঘূর্ণিঝড় আম্ফানকে ১৯৯৯ সালের পরে বঙ্গোপসাগরে প্রথম সুপার সাইক্লোন হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়ে এটি বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতীয় উপকূলজুড়ে আঘাত হানে। মার্কিন যৌথ টাইফুন সতর্কতা কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, আম্ফান বঙ্গোপসাগরে এ যাবতকাল পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় হয়ে উঠে। এটি ঘণ্টায় ২৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত (ঘণ্টায় ১৬৫ মাইল) অব্যাহত বাতাসের গতিবেগের সঙ্গে তীব্রতর হচ্ছিল।

ইতিহাস বলছে, অতীতেও সুন্দরবন নিজ বুক পেতে গ্রহণ করেছিল বহু ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াল ছোবল। নিকট-অতীতে সিডর ও আইলা প্রথমে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আছড়ে পড়েছিল সুন্দরবনের ওপর। আছড়ে পড়ার পরই সেই সময় তার জন্য প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সুন্দরবন। দেশের দক্ষিণে গড়ে উঠা এই ম্যানগ্রোভ বন অতীতে অনেক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত রুখে দেওয়ার জন্য দুর্ভেদ্য বনদুর্গের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

সুন্দরবন, বাংলাদেশ। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

সুন্দরবন ঢেউ ও ঝড়ের বিরুদ্ধে জৈব ঢাল হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘ ও চওড়া এই বন বন ঘূর্ণিঝড়জনিত জলোচ্ছ্বাস ও বাতাসের গতিবেগ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ২০১৭ সালে করা একটি গবেষণাপত্রেও বাংলাদেশে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষার জন্য সুন্দরবনের প্রয়োজনীয়তার উঠে আসে। ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রজাতির ভিন্নতা, তাদের ঘনত্ব ও ম্যানগ্রোভ বনের প্রশস্ততার ওপরেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষার বিষয়টি জড়িত বলে ওই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।

গবেষণা মতে, পঞ্চাশ মিটার থেকে দুই কিলোমিটার চওড়া ম্যানগ্রোভ বন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাকে ৪ সেন্টিমিটার থেকে ১৬.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। আর ৫০ মিটার থেকে ১০০ মিটার চওড়া বাইন ও কেওড়ার বন ২৯ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশ পানির গতিবেগ হ্রাস করতে পারে। সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছের ঘনত্ব ও তাদের শেকড় এবং কাণ্ডের ওপর জরিপ করে ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে কেওড়া, বাইন আর সুন্দরী গাছ যেকোনো উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের গতিবেগ কমিয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।