
পহেলা আগস্ট রাত ১টা ২০ মিনিটে ফেসবুকে সাহায্য চেয়ে একটি পোস্ট আসে। ঢাকার মিরপুর মাজার রোডের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধের পাশে ম্যানহোলের ভিতর বিড়ালের বাচ্চা পড়ে আছে।
রাত ১২টা থেকেই তার কান্নার শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা। কিন্তু পিচঢালা রাস্তার সাথে ম্যানহোলের লোহার ঢাকনা শক্তভাবে আটকানো। কেউ সাহস করছে না ম্যানহোলের ঢাকনা ভাঙবার বা ম্যানহোলে নামতে।
এরপর সাহায্য চেয়ে পোস্ট দিয়েছেন পলাশ দেওয়ান নামে একজন তরুণ। কাউকে পাওয়া যাবার কথা নয় এতো রাতে। এই শহরে একটি বিড়ালের বাচ্চার কান্না শুনে তাকে উদ্ধারে রাস্তায় নেমে আসবে এমন মানুষ কি সত্যিই পাওয়া যাবে?
ঘটনাস্থল আমার বাসার পাশেই। কিন্তু আমি নিজে তখন পাবনায়। প (PAW) ফাউন্ডেশনের একজন স্বেচ্ছাসেবী তাসনিম জান্নাত ঘটনা জানালেন আমাকে। আশা ছাড়লাম না।
অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সঠিক কৌশল, উপযুক্ত সিদ্ধান্ত এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবককে সঠিক গাইডলাইন দিলে অনেক কিছু সম্ভব। এ সময় কাকে অনুরোধ করা যায় চিন্তা করতেই মাথায় এলো একজন স্থানীয় প্রাণিপ্রেমির নাম, ওয়াজেদ।
ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করার সাথে সাথে সাড়া পাওয়া গেল। এক কথায় সে রাজী হয়ে গেল শাবল নিয়ে ঘটনাস্থলে যাবার জন্য। কিন্তু সমস্যা অন্যদিকে। এত রাতে শাবল নিয়ে একজন তরুণকে রাস্তায় দেখলে পুলিশ সন্দেহ করতে পারে। কাজেই সাথে আরেকজন দরকার।
ফেসবুকে খুঁজে এবং ফোন করে পাওয়া গেল মাজার রোডের বর্ধনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আরো দুইজন স্থানীয় তরুণ মিজানুর রহমান এবং তাসিন আজম। তাঁরাও এক কথায় প্রস্তুত হয়ে গেলেন উদ্ধারকাজে এগিয়ে যেতে।
যখন এভাবে উদ্ধারকারী খোঁজা হচ্ছে, একই সময়ে ফায়ার সার্ভিসকেও জানানোর কাজ চলছে। ফায়ার সার্ভিসে কয়েকবার ফোন করবার পর তারা ঘটনার গুরুত্ব এবং সত্যতা অনুধাবন করতে পারলেন। অবশেষে আশ্বাস পাওয়া গেল সহযোগিতা পাবার।
মিরপুর ১০ নং সেকশন থেকে মাত্র ২০ মিনিটের মাঝে ফায়ার সার্ভিসের একটি টীম চলে আসে। ততক্ষণে স্থানীয় তরুণরাও উপস্থিত। সাথে যোগ দিলেন পোস্টদাতা পলাশ দেওয়ান। শুরু হল উদ্ধারকাজ।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ফেললেন। দেখা গেল ছোট একটি বিড়াল ছানা যবুথবু হয়ে ভয়ে এক কোনে বসে আছে। ভিজে গিয়েছে সে বৃষ্টির পানিতে। বয়স হবে প্রায় এক মাস। একটি ফাঁদের মাধ্যমে বিড়ালের ছানাটিকে তুলে আনলেন একজন কর্মী। আনন্দে উল্লাস করে উঠলেন উপস্থিত তরুণরা।
অবশেষে বিড়ালটিকে লালন পালনের দায়িত্ব নিলেন তাসিন আজম। কিশোর বয়েসি তাসিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বেশ কিছুদিন হয় মায়ের সাথে এসেছেন বাংলাদেশে। নিজের আগ্রহ থেকেই মামা মিজানুর রহমানের সাথে অংশ নেন এই উদ্ধার অভিযানে।
“আমাদের গর্ব,আমাদের ভালবাসা বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ।
যাদের ট্যাগ লাইন হচ্ছে-দ্যা লাইফ সেভিংস ফোর্স“
যখন চারিদিকে সহিংসতা, সেবা বা প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে ভি আই পি, স্বজাতি নানান ধরণের বাছ-বিচারের সংস্কৃতি চলছে, ঠিক তখন বা তারও আগে থেকে এই একটি ডিপার্টমেন্ট বাছ-বিচার বাদ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যাদের একটিই লক্ষ্য- জীবন বাঁচানো। এই জীবন দোয়েল বা শালিকের, এই জীবন কুকুর বা বিড়ালের অথবা এই জীবন স্বজাতি মানুষের…কোন বিষয় নয় তাঁদের কাছে।
তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, রেস্কিউ বা সুরক্ষা দরকার প্রতিটি প্রাণির। বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে আমরা বলতে পারি- আমাদের দেশে সহিংসতা কতিপয় মানুষ করছে ঠিক, কিন্তু এদেশেই রাত ২ টায় বিড়ালের বাচ্চা ম্যানহোল ভেঙ্গে উদ্ধার করে তরুণরা এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আবার এরাই আগুন থেকে মানুষকে যেমন উদ্ধার করে, তেমনি কুকুরকেও ফেলে আসে না। এই কর্মীরাই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়ে দেয়… সেভাবে কোন প্রতিদান না পেয়েও।
সবার প্রতি অনুরোধ- এধরণের কাজকে অনুপ্রেরণা দিবেন,কিন্তু বিদ্রূপ করবেন না। কারণ-যে মানুষ বা টিম আগুনে দগ্ধ কুকুর বা বিপদে পড়া বিড়াল উদ্ধার করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করেন, তিনি বা তাঁরা আপনার-আমার মত মানুষকেও বিপদে ফেলে চলে যাবেন না।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধ, আপনারা অন্যের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শুনে ভাল কাজে অনীহা দেখাবেন না, কর্মীদের সাহস দিবেন দয়া করে। বেঁচে গেল বিড়াল ছানাটি। সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা কিশোর তাসিন দেখে গেল, তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশ অমানবিক নয়।এদেশ নিয়ে এখনো আশা করা যায়। বাংলাদেশের মানুষ এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সামর্থ্য সীমিত হলেও তাঁদের চেষ্টার ত্রুটি থাকেনি।
শুধু তাসিন নয়, এই বার্তা পৌঁছে দেয়া উচিত প্রতিটি বাঙ্গালিকে। এদেশ ধর্ষকদের নয়, নয় সহিংস দানবদের। বাংলাদেশের হৃদয়ে রয়েছে মানবিকতার বীজ। তাকে অঙ্কুরিত হতে দিতে হবে। এটাই বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের ভালবাসা আর মানবিকতার দেশ।
লেখক: স্থপতি ও প্রাণি কল্যাণে নিবেদিত সংগঠক
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।