মা হারা গন্ধগোকুল ছানার বাবার গল্প

মায়ের মমতায় গন্ধগোকুল ছানার জীবন বাঁচানো সাব্বির আহমেদ শাকিল।

গেল ২৮ মে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার শাহজাহানপুরের মাঝিড়া ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মাসহ চারটি গোন্ধগোকুল ছানা আটক করে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় মা গন্ধগোকুলটি মারা যায়, কিন্তু বেঁচে যায় চার ছানা। শিক্ষার্থীদের সংগঠন ’তীর’- এর সদস্যরা গন্ধগোকুলগুলোকে উদ্ধার করেন। ওইদিনই ছোট্ট ছানাগুলোকে লালন পালনে সংগঠনটির সদস্য সাব্বির আহমেদ শাকিল ও তার পরিবারকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ বনবিভাগ। এরপরই শুরু হয় বন্যপ্রাণীগুলোর জীবন বাঁচানোর প্রাণপণ লড়াই।

জানা গেছে, গন্ধগোকুলের সদ্যজাত ছানাগুলোকে মানব শিশুর মতোই মমতা দিয়ে পালন করেন সাব্বির আহমেদ শাকিল ও তার পরিবার। তিনবেলা খাওয়ানো, চিকিৎসাসহ নিয়মিত দেখভাল করেছেন তারা। কিন্তু অসুস্থ হয়ে মারা যায় তিনটি ছানা। তবে হাল না ছাড়েননি সাব্বির। শেষ পর্যন্ত একটি ছানাতে পরম যত্নে রক্ষা রাখতে সক্ষম হন তারা। এরপর কেটে যায় ৩৮ দিন, যথেষ্টে পরিণত হয় ছানাটি। গেল ৬ জুলাই বনবিভাগের পরামর্শে গন্ধগোকুল ছানাটিকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেন সাব্বির আহমেদ শাকিল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি উঠে এলে- মায়ের মমতায় গন্ধগোকুল ছানার জীবন বাঁচানো ওই তরুণ বেশ প্রশংসিত হন। বন্যপ্রাণীর সন্তানদের বাঁচাতে সাব্বির আহমেদ শাকিল তাদের সংগ্রামের কথাগুলো তুলে ধরেন বেঙ্গল ডিসকাভার-এর সঙ্গে।

শুরুতে তিনি বলেন, “উদ্ধারের দিনেই বড় ভাই তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বলেছিলেন, নাও আজ থেকে তোমাকে চার বাচ্চার বাপ বানায়ে দিলাম। সেই থেকে শুরু… গন্ধগোকুল ছানাগুলোকে সময়মত খাবার দিয়েছি, খেলেছি, থাকার স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছি, গোসল দিয়ে শুকনো কাপড়ে মুছে দিতাম এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। প্রত্যেকটা দিন আমার বেশ আনন্দের সাথে কেটেছে বাচ্চাগুলো নিয়ে। যদিও অসুস্থতার জন্য মাঝপথে তিনটা বাচ্চাকে হারিয়ে ফেলি। শেষ পর্যন্ত একটি বাচ্চাই বেঁচে থাকে।”

”পরিচর্যার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা হলো আমার মায়ের। তিনি দুধ জ্বাল করে দিতেন, গরমের কারণে কখনও দুধ নষ্ট হয়ে যেত। মা আবার পাতিল তুলে দিয়ে নতুন করে দুধ গরম করতেন। সকালে আমি ঘুম থেকে দেরি করে উঠলে মা নিজেই খাইয়ে দিতেন। দুপুরে, বিকালে ও সন্ধ্যায় খাইয়ে দিতেন। বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন,” যোগ করেন সাব্বির আহমেদ শাকিল।

তিনি বলেন, “এক বেলায় মা, আরেক বেলায় আমি। আব্বা ব্যস্ত মানুষ, তিনিও এ কাজে সহযোগিতা করেছেন। মাঝে মধ্যে ছোট বোনকে বলতাম ছবি তুলে দিতে, ভিডিও করে দিতে। যা আপনারা দেখেছেন। ও একটু ভয় পেত, তাই কাছে আসতে চাইতো না। যখন বাচ্চাগুলো আমার মায়ের হাত থেকে খেতে চাইতো না, তখন আমি গিয়ে খাওয়াতাম। এতদিনে আমার সঙ্গে ওদের যে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।”

সাব্বির আহমেদ শাকিল বলেন, “যখন মা’র হাত থেকে খেতে চাইতো না তখন আমি ফিডারটা মুখে ধরতেই চুকচুক করে দুধগুলো সব সাবাড় করে দিতো। মাঝেমধ্যে আমার নিজের বাড়ির গাছের আম খাইতে দিছি, কলা খাইতে দিছি। চেষ্টার কোনো কমতি হতে দিইনি। রাতের বেলা উঠে দেখতাম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছানাগুলো। কি যে মায়া লাগতো ভাই তা বোঝাতে পারবোনা। কত মিষ্টি ছানাগুলো বাস্তবে দেখলে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারতেন…এভাবেই কেটে গেছে সময়।“

তিনি জানান, “এরইমধ্যে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক জহির আকন স্যার বললাম, বাচ্চাটাকে তো এখন ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু খুব মায়ায় পড়ে গেছি। স্যার বললেন, সন্তানকে বড় হলে মা-বাবা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়, বিয়েসাদী করায়- তবেই না স্বার্থকতা খুঁজে পান। তেমনি গন্ধগোকুলটাকে প্রকৃতির মাঝে ফিরিয়ে দিতে পারলেই তোমার স্বার্থকতা।”

”সেদিন মন দিয়ে স্যারের উপদেশগুলো শুনেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ছানাটিকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমি স্বার্থক। তবে একদিকে যেমন আনন্দ পেয়েছি, তেমনি দু:খ ভারাক্রান্তও হয়েছি। কারণ দীর্ঘ ৩৮ দিন নিজ সন্তানের মতোই পরিচর্যা করেছিলাম ছানাটিকে,” বলছিলেন সাব্বির আহমেদ শাকিল।