সাপ কামড়ানোা বা কাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘আতঙ্ক’ শব্দটি। গ্রামীণ জীবনে এ বিষয়টি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও তা বেড়ে যায় মে থেকে অক্টোবর মাসে। তবে সাপে কামড়ালেই যে বিষক্রিয়া হবে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। দেশে বিষধর সাপের চেয়ে নির্বিষ সাপের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু অপচিকিৎসা ও অজ্ঞতার কারণে সম্ভব হয় না আক্রান্ত মানুষের জীবন বাঁচানো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৯ জন সাপের কামড়ের শিকার হয়। এদের মধ্যে বছরে মারা যায় ছয় হাজার ৪১ জন। আশঙ্কার বিষয় হলো, এর মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ।
সারা বিশ্বে এই সাপে কাটার সংখ্যাটি প্রায় ৫৪ লাখ। এর মধ্যে বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হন ২৭ লাখ। ফলে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন অন্তত এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ।
বিষয়টিকে আমলে নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় বিশ্ব সাপে কামড়ানো বিষয়ক সচেতনতা দিবস পালন। যা প্রতিবছর ১৯ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে। সে থেকে এবার পঞ্চমবারের মত পালিত হচ্ছে দিবসটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্বের সাথে পালিত হচ্ছে এ দিবস।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগতভাবে প্রাণিপ্রেমিরা সচেতন করার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ ভেনম রিসার্স সেন্টার’ এর পক্ষ থেকেও পালিত হয় এ দিবস। বাংলাদেশ বন বিভাগ এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। এ দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সর্পদংশনের সঠিক চিকিৎসা প্রদানের নিমিত্তে সকল ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা:
* রোগীকে আশ্বস্থ করতে হবে। তাকে বার বার বলতে হবে ভয় পাবেন না, দেশের অধিকাংশ সাপ নির্বিষ। হাসপাতালে এর কার্যকর চিকিৎসা রয়েছে। সুতরাং ভয়ের কারণ নেই।
* হাত বা পায়ে দংশন হলে সেক্ষেত্রে হাত বা পা অচল রাখতে হবে। বাশের চেলা/চেপ্টা কাঠ/স্প্লিট এবং ব্যান্ডেজ/লম্বা কাপড় দিয়ে (৩-৪ ইঞ্চি চওড়া) যেমন গামছা, ওড়না ইত্যাদি দিয়ে বাঁধতে হবে। দংশিত অংশ অঙ্গ এমনভাবে বাধুন যেন বাঁধন অনেক বেশি শক্ত বা ঢিলা না হয়। বাঁধনের নিচ দিয়ে যাতে একটি আঙ্গুল চালনা করা যায়। হাত পা ভেঙ্গে গেলে যেভাবে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয় সেভাবে কাপড় ও কাঠ দিয়ে পেচিয়ে নিতে হবে যাতে গিড়া নড়াচড়া না করতে পারে।
* রোগীকে নিথর এবং নিশ্চল হয়ে বাম কাথে শুয়ে দিতে হবে।* রক্তক্ষরণ হলে চাপ দিয়ে ধরে রাখতে হবে।
* যদি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ থাকে তাহলে মুখে নল দিয়ে বা মুখে মুখ দিয়ে বাতাস প্রবেশ করাতে হবে কিংবা কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করতে হবে।
* কেবলমাত্র ভিজে কাপড়দিয়ে কিংবা জীবানুনাশক লোশন দিয়ে ক্ষতস্থান একবার মুছে ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থান ঢেকে রাখুন।
* যতদ্রুত সম্ভব দংশনকৃত অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ, টাগা খুলে ফেলুন।
* দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মটরবাইক বা এম্বুলেন্সের সাহায্য নিন।
সাপ কামড়ানোর পর যা করা যাবে না:
* দংশিত অঙ্গে কোন গিট দেওয়া যাবে না। ইতিমধ্যে গিট দেওয়া হয়ে গেলে তা অপসারণ করার জন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে।
* দংশিত স্থান কাটবেন না, সুঁই ফোটাবেন না, কিংবা কোন প্রলেপ দিবেন না।
* ওঝা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়ফুঁক করে সময় ক্ষেপণ করবেন না।
* হাসপাতালে নেওয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে দেবেন না।
* দংশিত স্থানে কোন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না।
* দংশিত স্থানে কোনভাবেই- হারবাল ঔষধ, পাথর, বীজ, মুখের লালা, পটাসিয়াম, কাদা, গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।
* তেল, ঘি, মরিচ, গাছ-গাছালির রস ইত্যাদি খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করাবেন না।
* দংশন স্থলে এলকোহল জাতীয় কিছু দেওয়া যাবে না।
* ব্যথা উপশমের জন্য এসপিরিন দেওয়া যাবে না।
* ভয় পাবেন না এবং রোগীর জন্য ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।
প্রতিরোধে করণীয়:
* বাড়ির আশে-পাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। বসত শোবার ঘরের সাথে খাবার সামগ্রী যেমন ধান-চাল, হাঁস-মুরগি, কবুতর না রাখা উত্তম। এসব সামগ্রী ইঁদুরকে আকর্ষণ করে যার খোঁজে সাপ ঢুকতে পারে।
* ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী টানিয়ে ঘুমান। খাটের উপর ঘুমাবেন, মেঝেতে ঘুমাবেন না। মশারি বিছানার নিচে গুঁজে দিয়ে ঘুমাবেন।
* রাতে বা অন্ধকারে হাটার সময় টর্চ ব্যবহার করুন। জঙ্গল বা ঝোপঝাড়ের ভেতর যদি হাটতে হয় তাহলে বুট জুতো বা লম্বা জুতো ব্যবহার করুন।
* গর্তের ভেতর না দেখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
* স্তুপ করা লাকড়ি বা খড়ের গাদায় সাবধানে হাত দিন। বড় পাথর বা কাঠের গুড়ি সাবধানে সরান।
* মাছ ধরার সময় চাঁই কিংবা জালের মধ্যে হাত দেওয়ার আগে সাপ আছে কিনা দেখে নিন।
* বেশির ভাগ সাপ রাতে সক্রিয় থাকে তাই রাতে হাঁটার সময় বা প্রাকৃতিক কাজে বের হলে আলো ও লাঠিসহ বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।
* বিষধর সাপ ও তার বাসস্থান সম্বন্ধে জানুন, যাতে তাদের এড়িয়ে চলতে পারেন।
* বাড়ির চার পাশ পরিষ্কার রাখুন। বাড়ী ও চাষ করার জমির মধ্যে দূরত্ব রাখুন।
* সাপ ছদ্মবেশী শিকারি, তাই সাপের শিকারের লুকানোর মত ময়লা আবর্জনা বাড়ির আঙ্গিনায় রাখবেন না।
পাতা, খড়, খড়ের গাদা, লাকড়ির স্তুপ, কাটা ঘাসের স্তুপ সাপের লুকিয়ে থাকার পছন্দের স্থান।
* সাপ বসত বাড়ির গর্তে বা ফাটলে লুকিয়ে থাকতে পারে বিধায় এগুলো মেরামত করুন।
* ঘরে প্রবেশের আগে লাইট জালুন।
* কেবলমাত্র প্রশিক্ষিত ব্যক্তির সাপ নাড়াচাড়া ও লালন-পালন করা উচিৎ। সাবধান, খালি হাতে সাপ ধরবেন না, কারণ সাপ মরার ভান করতে পারে।
সাপ দেখলে কী করবেন?
* অথথা ভয় পাবেন না।
* সাপের কাছে না ঘেঁষা বাঞ্ছনীয়।
* নিজ গতিতে সাপটিকে চলে যেতে দিন
* অনাবশ্যক সাপ মারবেন না।
* সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে দংশন করেনা। কেবলমাত্র আত্মরক্ষায় কিংবা সাপকে উত্যক্ত করলে সাপ মানুষকে দংশন করে।
চিকিৎসা:
এন্টিভেনম রয়েছে এমন চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে সাপে কামড়ানো রোগীকে। দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল এবং কিছু কিছু উপজেলা হাসপাতালে এন্টিভেনম রয়েছে। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তার রোগীকে ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণের জন্য হাসপাতালে রাখবেন। এর ভেতর যদি বিষধর সাপেকাটার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় সেক্ষেত্রে তার চিকিৎসা শুরু হবে। না হলে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশে মূলত ভারত থেকে আমদানিকৃত পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
এন্টিভেনমটি তৈরিতে খৈয়া গোখরা, রাসেল’স ভাইপার, স’স্কেলড ভাইপার ও পাতি কালকেউটের বিষ ব্যবহার করা হয়। এটি আমাদের দেশে সাপে কাটার চিকিৎসার একমাত্র এন্টিভেনম হওয়ায় সকল হাসপাতালে এই একই এন্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এই এন্টিভেনম ব্যবহারে রোগীর মৃত্যু রোধ হয় তবে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া থাকার সম্ভাবনা থাকে এবং অতিরিক্ত পরিমান এন্টিভেনম প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
পাশাপাশি অনেক সময় রোগীকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা হিসেবে ভেন্টিলেটর দিতে হয়। কিছু বিষের প্রভাবে কিডনি বিকল হয় সেক্ষেত্রে ডায়ালাইসিসের সুবিধা থাকতে হয় চিকিৎসা করার জন্য। সকল বিষয় নিশ্চিত করে চিকিৎসা করার সুযোগ সব হাসপাতালে থাকে না বিধায় চিকিৎসকেরা রোগীকে সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতালে নিতে বলেন।
এন্টিভেনমের বর্তমান অবস্থার উন্নতিলাভ, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং বাংলাদেশের সাপের বিপরীতে বাংলাদেশের সাপের বিষ থেকে এন্টিভেনম তৈরির নিমিত্তে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশে গবেষণা চলছে। যাতে এ দেশের সাপে কাটার চিকিৎসার নিজস্ব এন্টিভেনম তৈরি করা সম্ভব হয়। এই গবেষণা সফল হলে নির্দিষ্ট সাপের দংশনে নির্দিষ্ট এন্টিভেনম ব্যবহার করা সম্ভব হবে। যা দেশের মানুষের চিকিৎসার জন্য সুফল বয়ে আনবে, দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধান হবে, সাথে সাথে সরকার অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।