প্রকৃতি বাঁচাতে ব্যর্থ বিজ্ঞান!

প্রকৃতির বহু প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে বিজ্ঞান, এ দ্বায় মানুষের। কারণ পরিবেশ, প্রকৃতি জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন করে নিজেদের ভবিষ্যত নিরাপদ করতে শিখেছে মানুষ। আর তাই সেই আত্মকেন্দ্রিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও মননের চাষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

হোকনা প্রকৃতি বিকলাঙ্গ, হোকন সে প্রতিশোধ পরায়ন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তাই উদ্ভিদ, পশু-পখী, কীটপতঙ্গ বিলুপ্ত হয়েছে মাংসের লোভে, চামড়ার লোভে, দাঁতের লোভে, শিঙ্ং এর লোভে, অন্যান্য উপকরনের লোভে বা নিরাপদ জীবনধারনের আশায় একের পর এক অপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও নির্দেশনাহীন রাসায়নিকের অপরিকল্পিত প্রয়োগ সমগ্র দুনিয়াকে আজ সঙ্কটের মুখে ফেলেছে।

প্রতি বছর কৃষি জমিতে প্রয়োগ হচ্ছে হাজার হাজার টন কীটনাশক ও রাসায়নিক সার, পরিষ্কারের কাজে ডিটারজেন্ট, শিল্প কারখানার রং, পিগমেন্ট, রাসায়নিক ও খনিজ পদার্থ, সাজ সজ্জায় কসমেটিকস ও পার্ফিউম, সড়ক নির্মানে লুব্রিকেন্ট, তামা, দস্তা, পারদ, সীসা, কার্বন, হাইড্রোজেন, ফরমালিন, কার্বাইড, ডিজেল, পেট্রোল, প্রাকৃতিক ও খনিজ তেল সহ হাজারো ধরনের পদার্থ। যা ধ্বংস করছে মাটির গুনাগুণ ও উর্বরতা। যা পানির স্রোতে নদী-নালা, খাল-বিলে, পুকুর, জলাশয়-জলাধার ও সাগর সহ বায়ু মন্ডলের নিরাপদ সুস্থতা।

অন্যদিকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, নগরায়ন বা উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষ ও বনভূমি নিধন করতে করতে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও আমরা এখন পাঁচ থেকে চারভাগে এসে ঠেকেছি। ফলে বিজ্ঞানের কল্যাণে কার্বনের উৎপাদন বাড়লেও কমছে অক্সিজেন ভাণ্ডার। আর তাই ধেয়ে আসছে উষ্ণতা, খরা, মরু ও লবনাক্ততা। যা জলবায়ু পরিবর্তনের মহা-সঙ্কট বলা চলে।

ছবি: সংগৃহীত

বার বার প্রায় সব দেশ কার্বন নি:স্বরণের প্রতিশ্রতি দিলেও নিজের রাজনৈতিক সম্রাজবাদী আগ্রাসন ধরে রাখতে ব্যাপক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের একমুখী পস্থা অবলম্বন করছে। সালে সালে কত সাল জলবায়ু সুরক্ষার কথা বলে বিশ্ব নেতারা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারন করেছে, কিন্তু প্রকৃতির এক তিলও উপকারে আসেনি। তারা অন্ত:স্বারশুন্য মিথ্যার বেশাতি করলেও কার্বন নি:স্বরণ কমাতে তেল কয়লার বিপরীতে বা জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রতিষ্টিত করতে চরমভাবে ব্যার্থ। বরং পৃথিবীর মানবসভ্যতাকে আরামদায়ক ও টেকসই করতে যত না খরচ করছে তার চেয়ে হাজারগুণ অর্থ ব্যয় করছে মরণাস্ত্র তৈরিতে।

একদিকে হত্যা, ধ্বংস অন্যদিকে উন্নয়ন যেন প্রকৃতি ও মানবসভ্যতা ধ্বংসের নীল নকশা বুনে চলেছে ক্ষমতার মোহে অন্ধ মানুষগুলো। ম্যালথসের তথ্য অনুসারে, আজকের বিশ্বের এত উন্নতি পতনের পূর্বাভাস নয়তো?

১৮৯৭ সালের স্টিম ইঞ্জিন আবিস্কারের পর পৃথিবীব্যাপী যেন উন্নয়নের নহর। গুহায় বাস করা মানুষগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে শক্তিকে ভেঙ্গে গড়েছে একের পর এক আবিষ্কার। আজকে পিঁপড়ের সারির মত যানবাহন, ছত্রাকের কলোনির মত কলকারখানা , বিষাক্ত কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফারডাই-অক্সাইড, সালফুরেটেড হাইড্রোজেন, বিষাক্ত ধাতব কণা, কয়লা বা সিমেন্টের ফ্লাই অ্যাশ প্রভৃতিতে বাতাস টইটম্বুর যেন।

এর সঙ্গে সেদিনের বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয়া স্থলভাগের আজ আমূল পরিবর্তন, যা ভাবতে অবাক লাগে গত ২০০০ বছরে প্রকৃতি যতটা উষ্ণতা বাড়িয়েছে, সে পরিমাণ উষ্ণতা মানুষ বাড়িয়েছে গত চার দশকে।  ফলে পৃথিবী রূপময়ী হয়েও রঙ্গময়ী, কখনো জননী, কখনো যক্ষিনী, কখনো প্রাচীন আবার কখনো চিরনবীনা এবং নবীনেরই পিয়াসী। তাই তো তার বুকে কোন কিছুই স্থাবর নয় বরং পুরাতন জীর্ণ বস্ত্র পরিবর্তনের মতই নিজেকে সাজিয়ে নেয়।

ফলে উষ্ণায়নের কারণে বায়ুমন্ডল যেন হাজার বছর পেছনের সব ইতিহাস হাজির করছে ঘন ঘন নিম্নচাপ, সাইক্লোন, টর্নেডো, হারিকেন, জলোচ্ছাস সুনামি। আর নয় এবার থামাও তোমাদের লোভ ও ভোগ আকাঙ্কা ও আগ্রাসন। মাত্র পাঁচ দশকে পৃথিবীকে ধ্বংসের তলানীতে এনে ঠেকিয়েছে। নয়ত অতীতের মত ধ্বংস, ক্ষয় ও বিলুপ্তির পথে হাটতে হবে হরপ্পা মহেনঞ্জোদারো, সিন্ধু, মেসোপোটেমিয়া বা রাজস্থানের আর্য সভ্যতার মতই!

ছবি: সংগৃহীত

আর তাই উষ্ণায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্ষতিকর সব পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের, উজন স্তর ভেদ করে বেগুনি রশ্নী সরাসরি পৃথিবীতে এসে পড়ছে ফলে তাপ ও ক্ষতিকর রশ্মির সংস্পর্শে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া থেকে সৃষ্ট হরেক পোকামাকড় ও মশা মাছির উপদ্রব ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। তারা আজ পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে নিজের সহনশীলতা অর্জন করে নিয়েছে। কারো কারো ভেতর মিউটেশনও এসে গেছে, উদ্ভব হচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতির। তারা বিরুপ প্রাকৃতিক প্রভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে দৈহিক গঠন ও সংখ্যায় সমৃদ্ধ হচ্ছে দিনে দিনে।

তাতে পুরাতন রোগ সমূহ যেমন আরো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, তেমনি আমদানি হচ্ছে নতুন নতুন রোগের। এক সময় কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, হুপিংকাশি, ডিপথেরিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিসের মত রোগ রুপ পরিবর্তীত হয়ে বার্ডফ্লু, মেনিনজাইটিস, ইবুলা, সার্স, মার্স, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, প্রদাহ, এলার্জি, এইডস, বিকলাঙ্গ বা ক্যন্সার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

সেই পরাগায়নের বাহক মৌমাছি, ফড়িং, ভোমরা বা প্রজাপতি আজ বিলুপ্ত কারন বনের শাল, গর্জন, সেগুন, মেহগনি, ইউক্যলিপটাস, আকাশমণি, ঝাউ গাছ লাগাই ঘরে, যাদের অনেকে অক্সিজেনের বদল কার্বনডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে ও অক্সিজেন গ্রহণ করে ফলে বিরুপ প্রভাব তো সৃষ্টি হবেই।

আর ঘরের আঙ্গিনায় আম কাটাল লিচু জামের পাশাপাশি নিরাপত্তার চাঁদর বলা সেই অশোক, বাসক, বেল, নিম, তুলসী লাগাতে কার্পন্য করি। আর তাতে হারিয়ে গেছে দোয়েল, ময়না, শালিক, টিয়ে, ফিঙে, মাছরাঙ্গা, চড়ুই, বেনেবৌ,বুলবুলির মত হাজারো পাখপাখালি। যারা চোঁখের আড়ালে থেকে প্রকৃতি সুরক্ষার মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে আমাদের টিকিয়ে রাখত।

নেই তো আজ ঘরের টিকটিকি বা কোন ব্যাঙ বা সোনা ব্যাঙ যাদের একমাত্র আহার ছিল ঘরের মশা মাছির মত ক্ষতিকর পোকামাকড়। তেমনি নদী নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, পুকুর বা জলাশয়ে পোকামাকড় ও মশার লারভা বা শূক খেয়ে সুরক্ষা দেওয়া কই, চ্যাং, শোল, ল্যাটা, ভেদা, বাইন, টাকি, খলসে, ফলুই, পুটি, পুই ও আজ কীটনাশকের বিষাক্ত থাবায় হারিয়ে গেছে। ফলে ভয়ঙ্কর এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করছি আমরা।

উদাহারস্বরুপ, ফসল বাঁচাতে চীন সরকার চড়ুই পাখি হত্যার নির্দেশ দিয়ে তা বাস্তবায়নের পর শষ্য ক্ষতে এতটাই কীটপতঙ্গ বৃদ্ধি পেল যে অতীতের শষ্য ক্ষতির চেয়ে এই ক্ষতি ৫০গুণ বেড়ে গেল। তাই প্রকৃতিকে তার নিজের মত থাকতে দিন, সভত্যার বিপন্ন হবার ঝুকি কমান। কারণ মানুষের পক্ষে লালসাবৃত্ত নগরজীবন ছেড়ে বনে বাস যেমন অসম্ভব, তেমনি জীববৈচিত্র্য হীন নগর জীবন যেন পঙ্গু তাই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে না পারলে বিপর্যয় অবশম্ভ্যবী। মানুষ যতই উন্নতি করুক না কেন, তার উন্নতিতে বিজ্ঞান যত অসম্ভবকে সম্ভব করুক না কেন, প্রকৃতির খেলা ঘরে সে একটা সাধারণ খেলনা মাত্র।

লেখক: পরিবেশ সংরক্ষক ও সংগঠক, বাংলাদেশ

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।