একজন কাঠমিস্ত্রির কাজে করাত না হলেই নয় কিন্তু মাছ ধরার জন্য করাতের ব্যবহার, বিষয়টা অদ্ভুত নয় কি? এক ধরণের মাছ আছে যারা ঠিক এই কাজটিই করে থাকে। করাত/খটক মাছের নাকের লম্বা বর্ধিতাংশটি দেখতে অনেকটা করাতের মতো। তাদের এই করাতের উপর তড়িৎ সংবেদনশীল সেন্সর থাকে যা দিয়ে খুব সহজেই এরা পানির তলদেশে থাকা শিকারের অবস্থান বুঝতে পারে। নানা ধরণের ছোট মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদিকে এরা তাদের করাতের সাহায্যে পানির তলদেশে আটকে ধরে এবং করাত দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে।
শিকার ধরার কার্যকরী এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিগত প্রায় ৬ কোটি বছর ধরে, এমনকি ডাইনোসরদের বিলুপ্তির মত কঠিন সময় সফলভাবে পার করে এখনো করাত মাছ বা মিস্ত্রি হাঙ্গর পৃথিবীর বুকে টিকে রয়েছে। যদিও তারা ডাইনোসরদের বিলুপ্তির মত কঠিন সময় সফলভাবে পার করে এসেছে। কিন্তু বিশ্ব করাত মাছ দিবসে প্রশ্ন উঠছে- মানবসৃষ্ট হুমকি মোকাবেলা করে তারা কি পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারবে?
করাতের দুই পাশে ধারালো দাঁত থাকার কারণে এরা সহজেই মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে। ফলে তাদের টিকে থাকা আজ হুমকিতে। বিরল প্রজাতির মহাবিপন্ন এই মাছটি পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। করাত মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার আরো একটি কারণ হলো এরা দেরিতে (জন্মগ্রহণের প্রায় ১৫ বছর পর) বাচ্চা ধারণে সক্ষম হয় এবং খুব অল্প সংখ্যক বাচ্চার জন্ম দেয়। অনেক স্ত্রী করাত মাছ বাচ্চা ধারণে সক্ষম হওয়ার আগেই জালে আটকা পড়ে মারা যায়, ফলে পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাওয়ার সুযোগ পায় না।
বাচ্চা ধারণ ও প্রসবের সময় স্ত্রী করাত মাছগুলো করাতের আঘাত থেকে সুরক্ষিত থাকে কারণ শিশু অবস্থায় বাচ্চা মাছের করাতটি খুবই নরম থাকে। তাছাড়া করাত মাছের গায়ের সবগুলো হাড়ই মানুষের নাকের হাড়ের মতো নরম তরুনাস্থি দ্বারা গঠিত। করাত মাছ আসলে তরুনাস্থিময় কঙ্কালযুক্ত হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছের একই গোত্র Chondrichthyes এর অন্তর্ভুক্ত।
শিশুকাল থেকেই করাত মাছ তার নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করে। যদিও এরা খুব ধীরগতিতে বড় হয় কিন্তু আকারে বিশাল হতে পারে। দুই বছর আগে আমরা খুলনার রূপসা ঘাট সংলগ্ন মাছের আড়ৎ থেকে প্রায় একটনের কাছাকাছি ওজনের একটি করাত মাছের তথ্য সংগ্রহ করি। মাছটি একটি বাণিজ্যিক ট্রলারের জালে আটকা পড়েছিলো এবং পরবর্তীতে রূপসা ঘাটে অবস্থিত মাছের আড়ৎে বিক্রির জন্য আনা হয়েছিল।
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত রেকর্ডকৃত করাত মাছগুলোর মাঝে এটি সবচেয়ে বড় এবং পুরো বিশ্বে পাওয়া গেছে এমন বড় করাত মাছগুলোর মাঝে অন্যতম। “স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই বিশাল মাছটি প্রায় ১৫ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ মাছের প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হয়েছে প্রায় ১০০০-২০০০ টাকায় এবং পাখনাগুলো বিক্রি হয়েছে ২০,০০০ টাকায়,” জানান ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি বাংলাদেশের মেরিন প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর জি এম মাসুম বিল্লাহ।
“মহাবিপন্ন মাছটি রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবী থেকে চিরদিনের মত হারিয়ে যাবে। যা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলিফা বিনতে হকের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী, ২০১৭ সালে প্রতি মাসে গড়ে ২টি করে করাত মাছ ধরা পড়েছে, তার মাঝে একমাসেই সর্বোচ্চ ৮টি মাছ ধরা পড়ার রেকর্ড রয়েছে। মহাবিপন্ন মাছটির এই অস্বাভাবিক মৃত্যুহার খুবই আশঙ্কাজনক বিশেষ করে যেহেতু বাচ্চা ধারণে সক্ষম হতে এদের অনেক সময় লাগে এবং এরা খুব অল্প সংখ্যক বাচ্চা জন্ম দেয়।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী করাত মাছ হত্যা করা, কেনাবেচা করা বা এদের দেহের কোন অংশ খাওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এন্ডেজারড স্পেসিস (সাইটিস) এর সদস্যরাষ্ট্র হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে করাত মাছ বা এর যে কোনো অংশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অবৈধ।
আইন থাকা সত্ত্বেও কেনো বাংলাদেশের জেলেরা এখনও করাত মাছ ধরছেন এবং কেনোই বা করাত মাছের মূল্য এত বেশী? জি এম মাসুম বিল্লাহ‘র মতে, “কিছু লোক, বিশেষ করে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা এখনও এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন- করাত মাছের মাংস ঔষধিগুণ সম্পন্ন, যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে পারে। তাছাড়া অন্য দেশগুলোতে শুঁটকি করা করাত মাছের পাখনা একটি অভিজাত খাবার হিসেবে বিবেচিত, তাই অবৈধভাবে এই শুটকি পাখনাগুলো প্রচুর রপ্তানি হয়।”
“স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকায় জেলেদের জালে করাত মাছ ধরা পড়লে তারা তা ছেড়ে না দিয়ে উচ্চমূল্যের আশায় বাজারে নিয়ে আসেন, যা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
করাত মাছ রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে না পারলে বাঘ, মিঠাপানির ডলফিন/শুশুক এবং বনরুইয়ের মতো পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। জেলে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয় কমিউনিটি রেডিও প্রোগ্রাম, সকলের অংশগ্রহণমূলক প্রদর্শনী, তথ্যসম্বলিত গাইড বই বিতরণ সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত কুসংস্কার দূরীকরণে এবং করাত মাছ রক্ষায় জেলেদের উদ্বুদ্ধকরণে কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়াও আমরা করাত মাছের নিরাপদ অবমুক্তকরণ এবং দেশের আইন সম্পর্ক জেলেদেরকে সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য শনাক্তকরণ এবং বিচার প্রক্রিয়ার আওতাধীন করার লক্ষ্যে আমরা আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক করাত মাছ দিবসে সমুদ্রের এই মহাবিপন্ন প্রাণীকে টিকিয়ে রাখতে সকলের একান্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। যাতে সচেতনতা ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মহাবিপন্ন মাছটিকে চিরতরে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
লেখক পরিচিতি: (জামিয়া রহমান খান তিসা- ট্রেনিং এণ্ড এডুকেশন অফিসার এবং এলিজাবেথ ফাহরনি মনসুর- মেরিন কনজারভেশন প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজার, ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি বাংলাদেশ।)