
বাংলাদেশের বৃহত্তর পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটিতে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম লেক। কৃত্রিম লেক বললাম এ কারণে, এটি কোন প্রাকৃতিক লেক নয় রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে লেকটি। যে লেকের স্বচ্ছ বিশাল জলধারার উপর দিয়ে নৌকা চলছে, তার গভীর তলদেশে লুকায়িত লক্ষ লক্ষ মানব সন্তানের সর্বস্ব হারানোর বুকফাটা কান্নার ইতিহাস। যা আমরা অনেকে জানি না।
লেককে ঘিরে রাঙামাটির সর্বত্র গড়ে উঠেছে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের পর্যটন স্থাপত্য। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের পদভারে মুখরিত প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যের লীলাভুমি রাঙামাটি। কিন্তু এর ইতিহাসের কথা আমরা কখনো স্মরণ করার ফুরসত পাই না। অবশ্য এখন আর এসব খেয়াল রাখার প্রয়োজনীয়তাও অবস্থাদৃষ্টে অনেকটা কেটে উঠা গেছে বলে মনে হয়। তারপরও আজ রাঙামাটিতে এসে বিশ্বকবি রবী ঠাকুরের- গ্রামছাড়া এই রাঙামাটির পথ আমাকে শুধু মন ভুলায়নি পথ ভুলিয়ে বর্তমান থেকে ইতিহাসেও নিয়ে গেছে। তাই লেকের ঐতিহাসিক স্মৃতি রোমন্থন না করে পারলাম না।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সালে লর্ড কানিং এর ২২তম প্রশাসনিক নির্দেশে চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানকে একত্র করে একটি প্রশাসনিক এলাকা সৃষ্টি করা হয়, যার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। গভীর অরণ্যে ঢাকা পার্বত্য এলাকায় বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিলেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সরকার এই পাহাড়ি ভূখন্ডের জলধারা কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার এবং দাতা সংস্থা ইউএসএইড এর সহায়তায় শুরু হয় কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি সমন্বিত প্রকল্পের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ। দৈর্ঘ-প্রস্থ ও উচতায় বিশাল এই বাঁধ নির্মাণ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় বিরাট সমস্যা, বিরাট মানবিক বিপর্যয়। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির কারণে ৬৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। যারমধ্যে ছিলো ২২ হাজার একর চাষাবাদযোগ্য জমি ও ২৩৪ কিলোমিটার বনাঞ্চল। জমির ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট চাষাবাদযোগ্য জমির প্রায় ৪০ শতাংশ।
কাপ্তাই লেক নির্মাণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি বিলুপ্ত হয়েছে, প্রায় এক লাখ মানুষকে তাদের আবাসভূমি থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। যারমধ্যে ছিল ৭০ শতাংশই চাকমা জনপদের মানুষজন। যে লেকের জলের উপর আজ আমরা নৌকা ভ্রমণের মত আনন্দ উপভোগ করছি, তার তলদেশে রয়েছে লক্ষ মানবের বাড়ি-ঘর, রয়েছে রাজা সরদার কারবারীদের প্রাসাদ। এ কারণে তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনপদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ বেদনা, অসন্তোষ ও শান্তি বাহিনী নাম দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম।
আমেরিকার ঋণ এবং আমেরিকার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির তত্বাবধানে ৬৭১ মিটার লম্বা ৪৬ মিটার প্রস্থ এবং ৪৭ মিটার উচ্চতার বিশাল আকারের এই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সময় যে এক লাখ মানুষকে তাদের আবাসভূমি থেকে সরানো হয়েছিল তাদের সঠিক উপায়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। নির্মাণের সময় আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা করেনি পাকিস্তান সরকার। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের পরে এক লাখ মানুষের পুনর্বাসনের জন্য নেয়া পুরো ব্যবস্থাটিই ছিলো ত্রুটিপূর্ণ এবং অসন্তোষজনক।

দাতাদেশ ও কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ আদিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতির ব্যাপারটিকে আমলে নেয়নি। আদিবাসীদের জীবনযাত্রাকে তাদের কাছে মনে হয়েছিল ‘যাযাবর’ প্রকৃতির। যা অনেকটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ দায়সারা অমানবিকও বটে। বাঁধ নির্মাণের পর বন্যায় পাহাড়ি জনপদের আবাসভূমির পাশাপাশি প্রায় চল্লিশ শতাংশ কৃষিকাজ উপযোগী ভূমিও তলিয়ে যায়। এক লাখ লোকের পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ছিল না পাকিস্তানি পরিকল্পকদের। কারণ সমস্যাটা পূর্ব পাকিস্তানের ভূমিতে, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মত সিন্ধুতে হত তাহলে হয়ত সমাধান ভিন্ন হতো। প্রাথমিকভাবে যখন বাঁধের কাজ শুরু হয় তখন অনেক মানুষকেই কাসালং উপত্যকায় নিয়ে আসা হয়।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল সাফ করে সেখানে জমি তৈরি করে বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হয় আদিবাসীদের। ১৯৬২ সালের বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর সেই এলাকাও প্লাবিত হয়। পাকিস্তান সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন এরপর জোরালোভাবে আর কখনোই পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়নি। সমস্যাটা জিইয়েই রেখেছিল তারা উদ্যেশ্যমূলকভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। অরুণাচলে আশ্রয় নেয়া এই চাকমা শরণার্থীদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘পরিবেশগত কারণে সৃষ্ট শরণার্থী’ হিসেবে।
অরুণাচল প্রদেশে আশ্রয় নেয়া চাকমারা এখনো রাষ্ট্রহীন, ভারত কিংবা বাংলাদেশ কোনো দেশেরই নাগরিকত্ব নেই এই ভুক্তভোগীদের। পাহাড়ি এলাকায় বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত বিশ্বে অনেক আছে। নরওয়ের ‘আল্টা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’, ভারতে ‘সরদার সারোভার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ কিংবা কানাডার ‘জেমস বে প্রকল্প’ সব কয়টির জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ের জনগণকে তাদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অনেক ক্ষেত্রেই করা হয়েছে পুনর্বাসন, দেয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ।

কাপ্তাই লেকের ক্ষেত্রে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সেই ব্যাপারটি পুরোপুরি সম্ভব না হওয়ায় সমস্যা ঘণীভূত হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে কর্ণফুলীর ভাটির সমতলের চাষীরা লাভবান হয়েছে, মাছ চাষ আর বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের সমাদর পেয়েছে স্থানটি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে লক্ষাধিক আদিবাসীর নিজেদের বাস্তুভিটা ও আবাদভূমি হারানোর কান্না। সেই কান্না থামানোর জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সবাইকে এক কাতারে এনে বাঙ্গালীর সাথে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কর্মসূচি নিয়েছিলেন।
কিন্তু পাহাড়ি নেতা সেদিন তার বিরোধীতা করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে পাহাড়কে আরো অশান্ত করে তুলেছিল। পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো সে সুযোগে পাহাড়িদের আরো অশান্ত করার চেষ্টা বৈ কিছুই করেনি। বর্তমানে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়িদের চাকরি, আবাস, শান্তিচুক্তি, উন্নয়ন এবং যথাযথ পুনর্বাসনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের প্রতিনিধিদেরকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন করা হয়েছে। আশা করি, পাহাড়ি-বাঙ্গালীর সহাবস্থান এ সরকারের মাধ্যমে সুনিশ্চিত হবে এবং সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।