আমি এমন একজন পেশাজীবি, যার নামের ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করলে শিক্ষিত মানুষকে একটু দম নিতে হয়। কম শিক্ষিত মানুষেরা আবিষ্কার করেন এক নতুন শব্দ। আর অর্ধ শিক্ষিত বা শিক্ষাবঞ্চিত জনগণ সৃষ্টি করেন লেজে-গোবরে পরিস্থিতি। উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। গ্রামের বাজারে কোন কারণে উপজেলা পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তা এসেছেন। তাদের সম্মানে ও আপ্যায়নে এগিয়ে আসেন ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ ও বিত্তশালী লোকেরা। বিত্তশালীদের একজন হচ্ছেন এক ভেটেরিনারিয়ানের বাবা। সবাই পরিচয় করিয়ে দিলেন ইনি একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার বাবা। কর্মকর্তারা ভদ্রলোককে সম্মান জানিয়ে পাশে বসালেন।
একজন কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, “চাচা আপনার ছেলে কিসে চাকুরি করেন? জবাবে ভেটেরিনারিয়ানের বাবা বললেন,”আমার ছেলে ব্যাটালিয়ান সার্জন।” সবাই একটু নীরব হয়ে চারপাশে তাকাতে লাগলেন। আকারে ইঙ্গিতে অন্যদের হস্তক্ষেপ কামনা করলেন। পরিস্থিতি যে গোলা হয়ে যাচ্ছে তা চাচা বুঝতে পেরে নিজেই বললেন, “আমার ছেলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, বিসিএস পাশ করেছে।”
কৃষি অফিসার বলেই ফেললেন তাহলে আপনার ছেলে ভেটেরিনারি সার্জন। গ্রামের সহজ সরল বাবা তাঁর ছেলেকে এমন একটি ডিসিপ্লিনে পড়াশুনা করালেন যার নামটাই তিনি সঠিক করে বলতে পারেন না। আরেকটু যদি উপরের দিকে যাই যারা কিছু পড়াশুনা করেছেন, দুই একটা সনদও সংগ্রহ করেছেন সরকারের থেকে। তারা আমার ডিসিপ্লিনকে কীভাবে উচ্চারণ করেন? হয় তারা ভেটানি সাইন্স অথবা ভেটারি সাইন্সের মত একটা উচ্চারণ করেন। যারা এই উচ্চারণগত জটিলতায় যেতে চান না তাদের হাতে সহজ একটা শব্দ আছে তা হচ্ছে পশু ডাক্তার। আরেকটু শ্রুতি মধুর শব্দ ব্যবহার করলে প্রাণী চিকিৎসক। জেনে রাখা দরকার পশু ডাক্তার/প্রাণী চিকিৎসক শব্দগুলো ভেটেরিনারিয়ানের প্রতিস্থাপন নয়।
কিছুটা তৃপ্তিবোধ নিয়ে লিখছি। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পোষা প্রাণী-পাখি লালন পালনের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমি হাসপাতালে গেলে সিএনজি বা উবারে যাই। কিন্তু পোষা খরগোশ যখন আমার কাছে আসে সে মালিকের ব্যক্তিগত গাড়িতে আসে। আর ঐ মালিক কিন্তু আমাকে ভেট বলেই ডাকেন। আমাকে প্রাণী চিকিৎসক বললে আমাকে সংক্ষিপ্ত করা হয়। ছাঁটাই করা হয় আমার অনেক ভূমিকাকে। ভেটেরিনারি শব্দটার ব্রান্ডিং চাই। শুরু হয়ে গেছে অবশ্য উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল লিখতে এখন আমরা বাধ্য। জেলাগুলোতে আছেন জেলা ভেটেরিনারি অফিসার। বিভাগীয় পর্যায়ে উপ-পরিচালক, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের বর্ষপূর্তি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে নতুন ভেরিয়েন্টের আমদানী হয়ে গেছে। শেষ কোথায় না পারছি আমরা বলতে, না পারছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলতে। চলুন জেনে নিই জীবন না থামিয়ে রেখে কীভাবে মোকাবেলা করে যাচ্ছে বাংলার ভেট সমাজ।
এক
ভেটেরিনারিয়ানগণ জুনুটিক ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে যৌথভাবে কাজ করেন ওয়ান হেলথ এর মাধ্যমে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের সাথে সাথে পথে বসতে যাচ্ছিল প্রাণিসম্পদ পণ্যগুলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যানার-ফেস্টুনে পশু-পাখির মাধ্যমেও ছড়ায় ধরণের তথ্যগুলি আসছিল মিডিয়াতে। ভেট সমাজ এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন। বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ কো-অর্ডিনেটর একজন ভেটেরিনারিয়ান যিনি আউটব্রেকের পর থেকে অদ্যবধি ওয়েবিনার, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ মুভমেন্টের সাথে জড়িত। ভেটেরিনারি নেতৃবৃন্দকে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসের শুভেচ্ছা ও লাল সালাম।
দুই
প্রাণিজ প্রোটিনের উৎপাদন ও নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহে লকডাউনের শিকল ভেঙ্গে মাঠে নেমেছে ভেট সমাজ। উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য থাকছে খামারির পাশে পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে। খামারিদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য সররকার চালু করেছেন ডিম, দুধ ও মাংসের ভ্রাম্যমান বাজার। তাতে মনিটরিং করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেট সমাজ। অনেকেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন কেউ বা ফিরে এসেছেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে তবু পেশাগত দায়িত্বে থেকেছেন অটুট।
তিন
সমাজ তৃণমূল পর্যায়ে পিসিআর ব্যবহারে যখন হিমশিম খাচ্ছিল সরকার তখনই রেপিড ডট ব্লট এর মাধমে কোভিড-১৯ সনাক্তকরণ কিট আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন ভেট সমাজের অহংকার ড. বিজন কুমার শীল। কিট সরকার কিনেনি সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তাঁর গবেষণা অব্যাহত। হয়তো আরও কোন বড় চ্যাপটারে দেখা যাবে ড. শীলকে। স্বল্প প্রশিক্ষণে পিসিআর অপারেশনে যখন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা তখন তাদের পাশে টেকনোলজি নিয়ে হাজির হয়েছে আইসিডিডিআরবি’র ভেটেরিনারিয়ান ড. সৈয়দ মাজেদুর রহমান শাকিল। ভেটদের ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয় আইইডিসিআর।
পরবর্তীতে পিসিআর ল্যাবগুলোকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য গঠন করে ন্যাশনাল এক্সপার্ট পুল। যেখানে যুক্ত হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ভেটেরিনারি একাডেমিশিয়ান। তারা হলেন- মাইক্রোবায়োলজি প্রফেসর ড. নাজমুল হুসাইন নাজির, প্যাথলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নুরুজ্জামান খোকন এবং ড. রোকসানা পারভীন মিথুন। তাদের তৎপরতা এখনও অব্যাহত আছে। সবার আগে নিজেদের পিসিআর ল্যাবে মানুষের করোনা শনাক্তের দায়িত্ব নিলেন বিএলআরআইয়ের ভেটেরিনারিয়ারা। কোভিড-১৯ এর ক্রান্তিলগ্নে এটি বাংলাদেশের ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য একটি গৌরবময় অধ্যায়।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারিয়ানরাও তাদের পিসিআর ল্যাবে করেছেন কোভিড-১৯ পরিক্ষা। শুধু তাই নয় ভেটিরিনারি শিক্ষার এই চমৎকার বিদ্যাপিঠ জামালপুরস্থ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজকে পিসিআর মেশিন দিয়ে সহযোগিতা করেছে। চাঁদপু্র মেডিকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন করার সকল কারিগরি সহযোতিতা দিয়েছে সিভাসুর ভেটেরিনারিয়ানরা। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের কোভিড-১৯ পরিক্ষা ল্যাবরেটরিতে পিসিআর মেশিন সরবরাহ থেকে শুরু করে অন্যান্য সাপোর্ট সার্ভিস দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক। এরমধ্যে ফার্মাকোলজি প্রফেসর ড. পূর্বা ইসলাম অন্যতম।
চার
পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টস (পিপিই)’র অভাবে যখন চিকিৎসকরা কোভিড ওয়ার্ডে যেতে পারছিলেন না, ঠিক সেই মূহুর্তে ভেটেরিনারিয়ানদের ব্যবহারের নিমিত্ত পিপিইগুলো সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও জেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পাঁচ
কোভিড-১৯ ক্রাইসিস এ ক্ষতিগ্রস্থ খামারীদের প্রণোদনা দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এলডিডিপি প্রকল্প। আর তা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কঠোর পরিশ্রম করছেন অধিদপ্তরে কর্মরত ভেটেরিনারিয়ানরা।
পরিশেষে বলি, প্রাণী চিকিৎসক বা পশু চিকিৎসক নয় আমার ভেটেরিনারিয়ান বা ভেট শব্দটা চাই। হিউম্যান ডিজিজ কন্ট্রোলে ভেটদের যে ভূমিকা আছে সেটির ব্রান্ডিং চাই। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল ভেটেরিনারিয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস সফল হোক। করোনার কবল থেকে মুক্তি হোক মানব সমাজ।
লেখক:বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণী চিকিৎসক।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।