
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়া আসা রোহিঙ্গাদের কারণে এ দেশের কক্সবাজার অঞ্চলের বন্যহাতিরা এমনিতেই হুমকির মুখে। এরইমধ্যে ২৫ মে, মঙ্গলবার ভোরে জেলার উখিয়া উপজেলার থাইংখালী তানজিমারখোলা এলাকায় দলছুট হয়ে আটকে পড়ে একটি বন্যহাতি। ১৩ নম্বর শরণার্থী ক্যাম্পের কাছে অবস্থান করা হাতিটিকে ঘিরে ধরেন কয়েক হাজার উৎসুক রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গারা লাঠিসোটা, বাঁশ ও পাথর দিয়ে তাড়া করে হাতিটিকে। এ সময় হাতিটি বনে ফিরে যাবার পথ না পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দা, বনবিভাগ এবং প্রশাসনের লোকজনের তৎপরতায়ও সরানো যায়নি রোহিঙ্গাদের। দিনভর হাতির জীবন রক্ষায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বন্যপ্রাণী গবেষক, স্থানীয় প্রশাসনসহ স্থানীয় সচেতন মানুষেরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পালংখালি এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে আছে একটি খাল। ওই খালে জল পানের জন্য এসেছিল বন্যহাতির দল। বাকিরা ফিরে গেলেও আটকে যায় একটি হাতি। অবশেষে রাতে যখন রোহিঙ্গাদের ভিড় কমতে থাকে এক পর্যায়ে হাতিটি বনে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।
প্রাণী গবেষকরা জানান, এক সময় শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর আশপাশের পাহাড়ে অবাধ বিচরণ ছিল বন্যহাতির। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসস্থল তৈরির ফলে বিলীন হয়েছে হাতির বিচরণক্ষেত্র। তবে এখনো বন্যহাতিরা ক্যাম্পের কাছাকাছি আসে। তেমনই একটি হাতি পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালংখালি ইউনিয়নে ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছিল হাতিটি।
হাতিটিকে বনে ফেরত যেতে সহায়তা করা ৫নং পালংখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বেঙ্গল ডিসকাভার-কে জানান, ”যেখানে হাতিটি এসেছে সেটির নাম গাইনাকুলা এলাকা। এক সময় এই বনাঞ্চলটি হাতির অভয়ারণ্য ছিল। রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে এই বনটি নিশ্চিন্ন হয়ে গেছে। ভোরের দিকে হাতিটি আসে, আমরা সারাদিন চেষ্টা করেও হাতিটি বনে ফেরত পাঠাতে পারিনি। শত শত রোহিঙ্গারা ঘিরে ধরেছিল হাতিটিকে। রোহিঙ্গারা না থাকলে সকালেই হাতিকে বনে পাঠানো যেত।”
সরেজমিন থাকা বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে টেলিফোনে জানান, ”গেল ৬ মাস আগেও পালংখালি উপজেলার নানা প্রজাতির গাছ ছিল, কিন্তু ক্যাম্পগুলোতে থাকা রোহিঙ্গারা রান্নার কাজে যেগুলো কেটে ফেলেছে। এতে এই অঞ্চল বিচরণ করা হাতিগুলোর খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিলীন হয়েছে। বনাঞ্চলের পার্শ্বেই থাকা খাল পাড়ও এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। ফলে হাতির পানির চাহিদা পূরণের মাধ্যমগুলোও নেই।”
তিনি বলেন, “হাতিরা পরিযায়ী, খাবার ও পানির সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। আর প্রাণীটিকে সব সময় পানি কাছাকাছি আসতে হয়। যেখানে পানির ব্যবস্থা আছে, হাতি সেখানে যাবেই। পালংখালীর এই পাহাড় থেকে নামলেই খাল। জল পানে এসেছিল হাতিটি। সে খুব ভীত ছিল। মারমুখী রোহিঙ্গাদের চিৎকারে ১০ ফুটের ভিতরে পায়চারি করছিল সে। হাতি যেদিকেই মুখ ঘোরাচ্ছিল সেদিকেই চিৎকার করছিল মানুষ।”
”স্থানীয়দের মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি, গত পরশু রাতে একটি বাচ্চাসহ ৬টি হাতির দল পাহাড় থেকে নেমে আসে খালে জল পানের জন্য। তবে ভোরে দেখা যায় একটি হাতি বনে ফেরত যায়নি। আরেকটি বিষয় স্থানীয়দের মধ্যে হাতি দেখার বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু হাতির আসার খবরে রোহিঙ্গা ছেলে-বুড়ো সকলেই ঘিরে ধরে হাতিটিকে। রোহিঙ্গারা লাঠি, বাঁশ ও পাথর ছুঁড়ে মারছিল হাতির দিকে। পুলিশ, প্রশাসন ও বনবিভাগসহ স্থানীয় হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নিবৃত করে পারেনি,” উল্লেখ করেন আদনান আজাদ আসিফ।
বন্যহাতিকে নিরাপদে বনে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে অবদান ছিল পালংখালী উপজেলার স্থানীয় সচেতন মানুষেরা। আদনান আজাদ আসিফ বলেন, “বন্যহাতিকে নিরাপদ রাখতে বনে ফেরত পাঠাতে স্থানীয়দের নেতৃত্ব দেন উপজেলার চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী। সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন, শুধুমাত্র হাতিকে বাঁচাতে। উৎসুক রোহিঙ্গারা যাতে হাতির ক্ষতি করতে না পারে বা হাতি দ্বারা কারো ক্ষতি যেন না হয় এবং বনে ফিরে যেতে পারে সেটিই ছিল লক্ষ্য এবং এটিই হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের মধ্য থেকে একটি হাতিকে যে সুস্থভাবে বনে পাঠানো সম্ভব হয়েছে এটি বড় একটি বিজয়।”
বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ আকিজ ওয়াইল্ড ফার্মের সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে বেসরকারি সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের এলিফেন্ট রেসপন্স টিমের একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কক্সবাজার জেলায় কর্মরত আছেন। তিনি জানান, কক্সবাজার অঞ্চলে গত ৮ মাসে আনুমানিক প্রায় সাতটি হাতি মারা গেছে। তাই বন্যহাতির ক্ষতি না করে কিভাবে লোকালয়ে আসা হাতি বনে ফেরত পাঠানো যায়, হাতির আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা ও মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি।
তাঁর মতে, “বনবিভাগসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানী ঢাকা বা শহর কেন্দ্রিক জনসচেতনতার কাজ করে থাকে। কিন্তু বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এলাকার আশাপাশের লোকালয়ে সচেনতামূলক তেমন কোন কাজ হচ্ছে না। এতে হাতি বিচরণ করা এলাকার মানুষ জানেনই না যে হাতি হত্যা অপরাধ। আমি মনে করি, হাতি বিচরণ করা এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে,তাদেরকে জানাতে হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে হাতি আমাদের কতটা প্রয়োজন।”
সম্প্রতি বাংলাদেশে হাতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে ’প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা আন্দোলন’ এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন সংরক্ষণবাদীরা। তারা জানান, ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২২টি বন্যহাতি মারা যায়। যেগুলোর বেশিরভাগকেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন প্রাণি সুরক্ষাকর্মীরা।