সুন্দর ও বিষাক্ত সাপটি কৃষকের বন্ধু

লাল-ঘাড়-ঢোঁড়া সাপ। ছবি: সাঈদ বিন জামাল, আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ।

কৃষির জন্য অত্যন্ত উপকারী সরীসৃপ প্রজাতির অস্তিত্ব বাংলাদেশে এখন বিপন্ন। অজ্ঞতাবশত মানুষ অকারণে দেখা মাত্রই মেরে সাপ। সম্প্রতি সাপ বিষয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায়ও এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।  কৃষিবিদরা জানান, কৃষি এবং পরিবেশের উপকারী সরীসৃপ। ধানক্ষেতের ক্ষতিকর ইঁদুর এবং পোকা দমনের ক্ষেত্রে সাপের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

প্রকৃতিবিদদের মতে, একটা জায়গায় সাপ না থাকার মানে হচ্ছে, ওই জায়গায় ক্ষতিকর ইঁদুর এবং পোকামাকড় বেড়ে যাওয়া। তেমনি কৃষকের উপকারি ও অন্যতম সুন্দর সরীসৃপ প্রজাতি লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপ। যেটিকে লাল-গলা ঢোঁড়া সাপও বলা হয়। এদের দেহ জলপাই-বাদামি বা সবুজাভ, গ্রীবা সিঁদুরের মত লাল। ক্ষতিকর ইঁদুর ও কীটপতঙ্গ খেয়ে সরীসৃপটি পরিবেশ এবং কৃষকের বেশ উপকার করে।

সম্প্রতি লাল-ঘাড়-ঢোঁড়া সাপের ছবি তুলেছেন বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী সাঈদ বিন জামাল। কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম এলাকা থেকে সাপটির কিছু ছবি তুলেছেন তিনি। বলেন, “বেশির ভাগ মানুষেরই সাপ সম্পর্কে জ্ঞান নেই। মানুষ মনে করে সাপ মানেই বিষাক্ত। বিষাক্ত এবং নির্বিষ সাপ সম্পর্কে মানুষ জানার চেষ্টাও করে না। সাপ দেখলেই চমকিয়ে ওঠে। মূলত সচেতনতা এবং শিক্ষার অভাবের কারণেই মানুষ সাপ মারছে।”

আলোকচিত্রী সাঈদ বিন জামালের মতে, ”আপনার বাড়ির ভেতর কেউ প্রবেশ করলে আপনি তো তাকে বাধা দেবেন তাই না? সাপের আবাসভূমি ধ্বংস করে আপনি পা দিচ্ছেন তার উপরে, তখন সে তো আত্মরক্ষার্থে আপনাকে আঘাত করবেই। কারণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রত্যেকটা প্রাণীরই রয়েছে।”

লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপের ইংরেজি নাম Red-necked Keelback (Rhabdophis subminiatus)। বিষাক্ত সাপের তালিকাভুক্ত হলেও এরা অত্যন্ত নিরীহ। সতর্কতা অবলম্বন করলে এই সাপের সাথে সহাবস্থান কঠিন কিছু নয়। শরীরে রঙের সৌন্দর্যে পূর্ণ এ সাপটি।

লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপের অপর বাঙলা নাম লাল-গলা ঢোঁড়া সাপ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর একটি সাপের প্রজাতি। এদের দেহ জলপাই-বাদামি বা সবুজাভ, গ্রিবা সিঁদুরের মতো লাল। লেজসহ সাপটির দৈর্ঘ্য ৭৫ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি বনাঞ্চলের খাল-বিল, ঝিরি বা পুকুরের আশপাশে এদের দেখা যায়।

সাপ গবেষকদের মতে, সাপটি বিষাক্ত নাকি নির্বিষ এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, তবে এদের Venomous Snake (বিষাক্ত) হিসেবেই ধরা হয়। অন্য বিষাক্ত সাপের মতো এদের বিষদাঁত নেই, তবে মাড়িতে পেছনে খাঁজকাটা দাঁত আছে যা দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে থাকে। সাপটির বিষও অন্যান্য সাপের বিষের মতো Neurotoxic, Haemotoxic বা Cytotoxic নয়, এদের বিষ কিডনিকে অকার্যকর করে দেয় এবং বিষের অ্যান্টিভেনম বিরল।

এছাড়া এদের ঘাড় থেকে এক ধরনের বিষাক্ত তরল নিঃসৃত হয়, যা শিকার ধরতে ব্যবহৃত হয়। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর এই তরল। এদের লালা রসও বিষাক্ত হয়। এদের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড আছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) লাল তালিকা অনুযায়ী, এরা সংকটাপন্ন। সৌন্দর্যময় এই সাপটি হত্যা এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে বর্তমানে লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপ প্রজাতি মারাত্মক হুমকির মুখে।

বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ বলেন, লাল-ঘাড় এমনিতে শান্ত ও নিরীহ স্বভাবের সাপ। তবে দিনের বেলায় এরা সক্রিয়। প্রজনন কাল জুন-জুলাই। খাদ্য হিসেবে ব্যাঙ, টিকটিকি, ইঁদুর ও অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবনধারণ করে। এদের দেখতে পেলে অযথা আতঙ্কিত হয়ে হত্যা না করে নিজের মতো চলে যেতে দিলে মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।