
দেশের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। নতুন উন্নয়ন কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রায় সাড়ে ১১শ গাছ কাটা হবে এমন খবর আসে। শুধু রিপোর্টার নয়, একজন প্রকৃতি-প্রেমী হিসেবে এ খবর কিছুটা ব্যথিতও করে আমাকে। যেহেতু প্রাণ-প্রকৃতি নিয়েই আমি সংবাদ করি সেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকৃতি-প্রেমীরা আমাকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ করতে থাকেন এ বিষয়ে কিছু করতে। যদিও অনুরোধ না করলেও আমি যেতাম। হাতে অনেকগুলো কাজ জমে থাকায় যেতে একটু দেরি হচ্ছিল।
এরই মধ্যে গাছ কাটার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিদিনই মিছিল মিটিংয়ের খবর পেতে থাকি। তারাও বারবার অনুরোধ করছিল ‘ভাই গাছগুলো বাঁচান’। শেষ পর্যন্ত একদিন ভোরে ইউনিট নিয়ে রওনা হলাম জাহাঙ্গীরনগরের দিকে।
প্রাকৃতিক ক্যাম্পাস হওয়াতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেই আমার ভালো লাগে। সাভারের দিকে কোনো কাজে গেলে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও জাবিতে ঘুরে আসি। সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ আমাকে আকর্ষণ করে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর অসংখ্য শিক্ষার্থী আমাকে অভিবাদন জানায়। সবার একই কথা, ভাই দেখেন একটু ভিসিকে বুঝিয়ে গাছগুলো বাঁচানো যায় কিনা?

আমি গিয়েই প্রথমে দেখার চেষ্টা করেছি হল নির্মাণের জন্য গাছ কাটার বিকল্প আছে কি না। ছাত্ররা আমাকে দেখিয়েছেন অনেক বিকল্প স্থান। বিশেষ করে কর্মচারীদের দখলে থাকা বিশাল এলাকার কথা বার বার বলছিলেন সবাই। সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল এলাকাজুড়ে কর্মচারীদের অনেকে টিনশেড ঘর করে বসবাস করছেন, অনেকে গরু-ছাগলও পালন করছেন। তবে অধিকাংশেরই খুব দুর্বল ঘরবাড়ি ছিল, যা আমার চোখ এড়ায়নি। এরসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের ভেতর কিছু ফসলি জমিও আমার চোখে পড়েছে। যা ভরাট করে একসাথে অনেকগুলো ভবন করা যায়, যাতে একটি গাছও কাটার প্রয়োজন হয় না।
আমার উপলব্দি বলছে, যদি উন্নয়ন প্রকল্পটি একটি দীর্ঘমেয়াদী ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে হতো তাহলে কর্মচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন করে তাদের পুনর্বাসন করা হলে তারাও উপকৃত হতো একইসঙ্গে বিশাল জায়গাও বেঁচে যেতো। যেখানে নির্মাণ করা যেত নতুন হলগুলো।
নতুন হল নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের শান্তি নিকেতন এলাকায় গিয়ে আমার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। এত সুন্দর সাজানো গোছানো বাগান কিভাবে কাটার চিন্তা করা যায় বুঝে আসছিল না। শান্তি নিকেতনের মাটি ছিল সবুজের কার্পেট। দুপাশে দুটি প্রাকৃতিক লেক। পাখির কুহুকুহু ডাক আমাকে মাতাল করে দিচ্ছিল। সেখানে আমার চোখে পড়েছে নিম, চালতা, বহেরাসহ নানা প্রজাতির সারি সারি গাছ। দেখেছি আপন মনে গুইসাপ আর কাঠবিড়ালির বিচরণ। আর ভাবছিলাম, গাছগুলো কেটে ফেললে এদের স্থান হবে কোথায়। এভাবেই ধীরে ধীরে হারাবে প্রকৃতির প্রাণী আর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এখানে হল নির্মাণ কতটা পরিবেশ সম্মত জানতে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আমির হোসেন ভূঁইয়া স্যারের কাছে। প্রশাসনিক কারণে তিনি খোলামেলা কথা বলতে না পারলেও এক কথায় বুঝিয়েছেন নির্ধারিত স্থানে হল হলে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুয়ারেজ লাইন নেই বলে জানিয়ে তিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন, ‘নতুন হলগুলো হলে দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে আগামী ৮-১০ বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা কঠিন হয়ে যাবে। একই সঙ্গে খুব শিগগিরই অতিথি পাখির বিচরণও ভয়াবহভাবে কমে যাবে বলেও জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন পরিকল্পনার কোনো কাজে তাদের সম্পৃক্ত করেনি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কোনো পরামর্শ নেয়নি। তবুও আমি স্বউদ্যোগী হয়ে ভিসি ম্যামকে বলেছি শান্তি নিকেতন এলাকার মাটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে যা খুব একটা দেখা যায় না। তাই ওখানকার মাটির গঠনগত ক্ষতি না করে উন্নয়ন করার অনুরোধ করেছি, তিনিও বিষয়টি খেয়াল করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।

সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ স্যার। তাঁর কাছে গেলে তিনি জানান, শুধু প্রকৃতি নিধন নয়, বড় ধরনের দুর্নীতিও হচ্ছে এ প্রকল্পে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর উন্নয়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্ট গবেষক থাকলেও কাউকে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করাকে সন্দেহজনক বলে দাবি করেন তিনি। একইসঙ্গে প্রকল্পটির কাজ শুরুর আগে পরিকল্পনাটি অন্তত তিন মাস ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করে সবার মন্তব্য নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো ডজনখানেক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সরাসরি কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে অধিকাংশই বলেছেন, এ উন্নয়ন কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করবে। এ কাজে তাদের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু চাকরির স্বার্থে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না তারা। শতাধিক শিক্ষার্থীরও ছিল একই মত।
ভিসি ম্যাম কখনো অট্টহাসি দিয়ে আমাকে তাচ্ছিল্য করেছেন,কখনো তুমি কিংবা তুই বলেও সম্মোধন করেছেন!
সবার মতামত নিয়ে গিয়েছিলাম উপাচার্যের কার্যালয়ে। দেশের প্রথম নারী উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামকে অত্যন্ত নরম দিলের মানুষ হিসেবে জানতাম আমি। অজানা কারণে অন্যরকম শ্রদ্ধাও ছিল তাঁর প্রতি। প্রথমদিন রাত আটটা পর্যন্ত বসে থেকেও উপাচার্যের দেখা মিলেনি। পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে আবারও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। অবশেষে দেখাও মিলে ভিসি ম্যামের। খুব সম্মানের সাথে নরম স্বরে আমার নজরে আসা বিষয়গুলো তুলে ধরে তাঁর বক্তব্য জানতে চাই। সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে সম্মানিত এ শিক্ষক যে আচরণ করেছিলেন, সেই শিক্ষা হয়তো আগামীতে আমাকে কারো সঙ্গে অতি উত্তম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করবে।

খবরের কাজে গেলে আমি সবসময় মনে করি আমি সাংবাদিক। বিবাদে জড়ানো নয়, খবর সংগ্রহই আমার কাজ। খুব বেশি বাধ্য না কখনো তর্কে জড়াই না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাই তিনি যত খারাপ ব্যবহার করেছেন, আমি তত ভালো ব্যবহার দিয়ে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব নেয়ার চেষ্টা করেছি।
এতগুলো গাছ না কেটে বিকল্প ভাবা যায় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জবাব দিয়েছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বোটানিক্যাল গার্ডেন ছিল না, এটা কোনো চিড়িয়াখানাও নয়, এটা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্ব, গাছপালা পশুপাখির দায়িত্ব আমার না।”
আমি পাল্টা প্রশ্নে বলেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে সবাই শিখে তাই জাবি কি বিকল্প ব্যবস্থা করে দেশ ও বিশ্ববাসীকে প্রকৃতি সংরক্ষণের নতুন নজির দেখাতে পারে না? জবাবে তিনি বলেন, তাহলে আমি একটা কাজ করি ছাত্র বাদ দিয়ে গাছপালাকে পড়াই!
প্রশ্ন করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক খালি জায়গা আছে,কর্মচারীদের হাতে অনেক জায়গা আছে সেটা বাছাইয়ে কোনো বাধা আছে কি? খুব তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি জবাব দিয়েছেন, গাছপালার প্রাণ আছে, কর্মচারীদের বুঝি প্রাণ নেই?
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়েও তিনি নানা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আজ তারা সুনাগরিক সেজে টাকা পয়সার হিসাব চাইছে। কিন্তু একেকজন যে চার বছরের কোর্স ৫/৬ বছর লাগিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করে তখন হিসেব কই যায়?
বাম সংগঠনগুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, কই ছাত্রলীগও তো আছে ক্যাম্পাসে তাদেরতো জ্বলে না বামদের এত জ্বলে কেন? ‘শুনো মানুষের কথা শুনে কম নাচো’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। সবশেষে যখন বেরিয়ে আসছিলাম, দরজার পার হতেই ভিসির রুমে থাকা কেউ একজন পেছন থেকে বলে উঠেন ‘মানুষের দালালি বাদ দিয়ে নিজে কিছু জানলে বইলেন’। তখন খুব রাগ হয়েছিল তবুও শেষ মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বেরিয়ে এসেছি।
যাইহোক, সেদিন ভিসি ও তার চ্যালারা অনেক দাম্ভিকতা দেখিয়েছেন। নিজেদের নির্দোষও দাবি করেছেন। কিন্তু এখনতো প্রমাণ মিললো সেই দুর্নীতির। মিললো ছাত্রলীগের চুপ থাকার কারণও। শুধু আমি নয় তারা যে আরো সাংবাদিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে সে সংবাদও প্রকাশ্যে এসেছে। এখন পত্রিকার পাতায় এসব খবর পড়তে পড়তে মিট মিট করে হাসি। আর আমি বোকা মনে মনে ভাবি, কে কতটা জানে তার প্রমাণতো ব্যবহারেরই মিলছে!
লেখক: প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক প্রতিবেদক, সময় টেলিভিশন, বাংলাদেশ ইমেইল: kafayet.chowdhury@gmail.com
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।