বিলুপ্তির মুখে বাংলাদেশের গ্রে হাউন্ড!

বাংলাদেশের সরাইলের গ্রে হাউন্ড কুকুর।

বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় গ্রে-হাউন্ড বা সরাইল হাউন্ড কুকুর বেশ নামকরা। সরাইল হাউন্ডের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি ও শিকারে দক্ষতার কারণে পাহারাদার কুকুর হিসেবেও জনপ্রিয়। প্রভুভক্তির জন্য পোষা প্রাণী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও রয়েছে সরাইল হাউন্ডের কদর। এই কুকুরের দেহ তিন থেকে চার ফুট লম্বা। কান ও মুখ বেশ লম্বাটে। পেট ছোট হলেও বুক চওড়া। লেজটা চিকন ও লম্বা। হালকা–পাতলা গড়নের এই কুকুরের পা ও পায়ের নখ লম্বা। বাদামি রঙের চোখ দুটি বড়।

শুধু আকৃতি বা দৈহিক গঠনের দিক থেকে গ্রে-হাউন্ড অন্যান্য কুকুরের চেয়ে আলাদা তা নয়। আচরণের দিক থেকেও আলাদা। হাঁটাচলা বা দৌড় দেওয়ার ভঙ্গি ভিন্ন। ঘুমের অভ্যাসেও আছে ভিন্নতা। শুধু ঘ্রাণশক্তি নয়, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির মাধ্যমে শিকার ধরা এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্রুতগামী কুকুরটি অন্য কুকুরের মতো আহ্লাদী হলেও অপরিচিতদের আদর একদম পছন্দ নয়।

দিনের বেলা ঘেউ ঘেউ করা স্বভাব না হলেও রাতের ঘেউ ঘেউ শব্দে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ত্রিসীমানায় আসতে পারে না। কুকুরটি শত্রুর জন্য খুবই হিংস্র ও ভয়ঙ্কর। এই কুকুর পোষা শৌখিনতা এবং আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে, পালনও যথেষ্ট ব্যয়বহুল। প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন কুকুরটির খাদ্যতালিকায় আছে দুধ-ভাত ও মাংস। এদের জীবনকাল হয় এক যুগ।

সরাইল হাউন্ডের ইতিহাস

কথিত আছে, একবার সরাইলের জমিদার দেওয়ান হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে এক ইংরেজ সাহেবের কাছে একটি সুন্দর কুকুর দেখতে পান। তিনি কুকুরটি কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেব থেকে ওই কুকুরটি (মাদি-স্ত্রী জাতের) নিয়ে এসেছিলেন।

একদিন শিকারে বের হয়েছিলেন দেওয়ান। এক পর্যায়ে মাদি কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। কিছুদিন পর গর্ভবতী হয়ে ফিরে আসে কুকুরটি। কদিন পরই দেওয়ানের বাড়িতে কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা দেয়। দেখা গেল, এসব বাচ্চা সাধারণ কুকুরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বাঘের বেশ মিল আছে। ধারণা করা হয়, নেকড়ের সঙ্গে ওই কুকুরের মিলন থেকে জন্ম নিয়েছিল ওই বাচ্চাগুলো।

কথিত আছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হলে সে সময় তাঁর পোষা দুটি সরাইল হাউন্ডের একটির সাহায্যে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

সীমান্তবর্তী উপজেলা সরাইলের নামে এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়। মূলত মুঘল আমলের সামন্ত জমিদারদের মালিকানাধীন ইংরেজ গ্রে-হাউন্ড ও সাইট-হাউন্ড বা আরব বণিকদের আনা শিকারি কুকুর গোত্রের বংশোদ্ভূত বলেও ধারণা করা হয় এই সরাইল হাউন্ড। সরাইলের ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত গ্রে-হাউন্ড কুকুর।

এখন যেমন আছে সরাইল হাউন্ড

সময়ের পলাবদলে কমেছে এ কুকুর পালন। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা রবি দাস পরিবার সরাইল হাউন্ডকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষায় নিরন্তর চেষ্টা করছেন। বিপন্ন এই প্রজাতির হাতেগোনা কিছু পালকদের মধ্যে রবিদাস ভাতৃদ্বয় অন্যতম। তপন রবি দাস ও যতন রবি দাস পারিবারিক সূত্রে পালন করে আসছেন সরাইল হাউন্ড।

মোহনলাল রবি দাসের ছেলে তপন লাল রবি দাস জানান, শত বছর আগে সরাইল পরগনার তৎকালীন জমিদার দেওয়ান মনোয়ার আলী ওরফে মন্নর আলীর সঙ্গে তাঁর দাদা গঙ্গাচরণ রবি দাস ও দাদার বাবা কালীচরণ রবি দাসের সুসম্পর্ক ছিল। তাঁরা তখন উপজেলা সদরের বাসিন্দা ছিলেন। পরে দেওয়ান পরিবারের সহায়তায় কালীচরণ রবি দাসের একমাত্র ছেলে গঙ্গাচরণ রবি দাসকে নিয়ে চৌরাগোদা গ্রামের নির্জন এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।

”দেওয়ান মন্নর আলী আমার দাদারে খুব আদর-স্নেহ করত। তিনিই প্রথম দুটি কুকুর দান করেন। সেই থেকে আমরা এই কুকুর পালন ও বিক্রি করে আসছি। এক মাসের একটি বাচ্চা বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। পূর্ণ বয়স্ক (দেড়-দুই বছর) একটি কুকুর বিক্রি হয় ৫০ হাজার টাকায়,” যোগ করেন তপন লাল রবি দাস।

শৌখিন সরাইল হাউন্ড পালনকারীরা জানান, একটি কুকুর পালনে একজন মানুষের সমান খরচ হয়। খাবার হিসেবে সপ্তাহে অন্তত দুদিন মাংস, তিনদিন দুধ দিতে হয়। জন্মের ৫–৬ মাস পর্যন্ত শুধু দুধই খাওয়াতে হয়। যত্ন করতে হয় নিয়মিত। সুন্দর পরিবেশে রাখতে হয়, চিকিৎসা দিতে হয়। কুকুর পালনের এই খরচ মেটানো অনেকের পক্ষেই এখন সম্ভব নয়। তাই এ প্রজাতির কুকুর দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে।

তপন রবি দাস বলেন, ”একসময় প্রায় প্রতিটি পরিবারই সরাইল পালন করতো, কিন্ত এখন খুব অল্পসংখ্যক পরিবারেই দেখা যায়। অনেক জনপ্রতিনিধি যুগ যুগ ধরে কথা দিয়ে গেছেন। গ্রে-হাউন্ড কুকুর সংরক্ষণে উদ্যোগ নিবেন, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। অতিকষ্টে আমাদের পরিবার এখনো এই জাতটা পালন করে যাচ্ছি।”

কুকুর পালনের ব্যয় মেটাতে হিমশিম অবস্থা পেশায় মুচি তপন রবি দাস ও যতন রবি দাসের। ছানা বিক্রির টাকায় কুকুরগুলোর জন্য মাংস কিনে আনে রবি দাস পরিবার। বিশ্বের সবচেয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে একখন্ড জমি যেখানে দুষ্প্রাপ্য সেখানে সরাইল পালন রীতিমত বিলাসিতাও। অতিরিক্ত খরচের কারণে পরবর্তী প্রজন্ম পারিবারিকভাবে সরাইল পালন বন্ধ করে দিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রবি দাস পরিবার।

সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ

১৯৭০ সালেও এমন একটি প্রচেষ্টা চালানো হয় যা ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উপজেলা সদরে নির্মাণ করা হয়েছিল গ্রে-হাউন্ড কুকুর সংরক্ষণ কেন্দ্র। তবে উপযুক্ত চিকিৎসা, সুষ্ঠু পরিচালনা এবং আর্থিক সঙ্কটের কারণে কয়েক বছর পরই বন্ধ হয়ে যায় সেটি। ২০০১ সালে উপজেলা সদরের বড় দেওয়া পাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ঠাকুর সরাইলে বাণিজ্যিক কুকুর প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও সফল হয়নি।

সম্প্রতি ঢাকার কয়েকজন অভিজাত ব্যক্তি বিপন্ন প্রজাতির এই কুকুর সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। একটি ফেসবুক গ্রুপ- সরাইল হাউন্ড অব বাংলাদেশ গ্রে হাউন্ড কুকুরের বিভিন্ন তথ্য এবং বংশবিস্তার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয় এতে। ৫৮ বছর বয়সী ব্যাংকার, কায়সার তমিজ আমিন এই গ্রুপটি পরিচালনা করেন। তিনি দুই দশক ধরে সরাইল পালন করে আসছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশে আর কেবল মাত্র ৩০-৪০টি বিশুদ্ধ বংশজাত সরাইল রয়েছে। প্রতিকূলতা থাকলেও জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে এই প্রজাতির বিশুদ্ধতা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এখনো সরাইলে ৮-১০টি গ্রে-হাউন্ড কুকুর আছে। কিন্তু ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশ সংকর জাতের বিস্তার ঘটেছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিলে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করা সম্ভব সরাইলের গ্রে-হাউন্ড।