বাংলাদেশে লাজুক বানর নিয়ে বিশেষ গবেষণা

বাংলাদেশের বন্য পরিবেশে লজ্জবতী বানর বা লাজুক বানর। ছবি: হাসান আল রাজী, বন্যপ্রাণী গবেষক।

রাতে খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়, দিনে গাছের ডালে তুলোর বলের মতো ঘুমায়- নিশাচর এই প্রাণির নাম লজ্জবতী বানর বা লাজুক বানর। বিশ্বে আছে এটির সাতটি প্রজাতি, বাংলাদেশে আছে একটি- ‘বেঙ্গল স্লো লরিস’। এটি দেখা যায় এ দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে। এ দেশের বনে  লজ্জাবতী বানরের বৈজ্ঞানিক নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে চলছে একটি গবেষণা প্রকল্প।

বন বিভাগের সহযোগিতায় জার্মানভিত্তিক দাতা সংস্থা প্লামলরিস ই.ভি’র অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে গবেষণাটি। এটি তদারকি করছেন বাংলাদেশের তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক হাসান-আল রাজী। ইতিমধ্যে গবেষণা কাজে সংগ্রহ করা হয়েছে উদ্ধার করা দু’টি লজ্জাবতী বানর। এই দুটি বানরের গলায় যুক্ত করা হবে ট্র্যাকিং ডিভাইস- এটিকে কলারিংও বলা হয়। এর আগে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহে ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা হলেও বানর গোত্রীয় প্রাণীদের দেহে এটাই প্রথম।

উদ্ধার হওয়া লজ্জাবতী বানরদের রাখা হচ্ছে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া বনে অবস্থিত জানকীছড়া ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারে। তবে ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগানোর পর লজ্জাবতী বানর দু‘টিকে প্রাথমিকভাবে ছাড়া হবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। এরপর থেকেই তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হবে। এতে জানা যাবে নতুন পরিবেশ ও প্রতিবেশে প্রাণিগুলো কতটা মানিয়ে চলতে পারছে বা কীভাবে টিকে থাকছে। শিগগিরই বানর দু’টি বনে ছেড়ে দেয়া হবে বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

গবেষকদের মতে, আজকাল বনের বাহিরে লোকালয়ে বেশি বিচরণ করছে এই প্রজাতিটি। এর কারণ বনে নিরাপদ আবাস ও খাদ্য সংকট, পাশাপাশি রোগাক্রান্ত হয়ে বা দুর্ঘটনার শিকার হয়েও আসছে মানুষের আশপাশে। তবে লোকালয়ে আসা বানরদের ফিরিয়ে দেয়া হয় বনে। কিন্তু বনে যাওয়ার পর কেমন থাকে বা নতুন জায়গায় স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছে নাকি এবং স্থানীয় বানরেরা গ্রহণ করছে কিনা ইত্যাদিসহ নানা তথ্য জানা যাবে শুরু হওয়া গবেষণায়।

উদ্ধার করা লজ্জাবতী এই বানরটি গবেষণা প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে।

গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক হাসান আল রাজী বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “লজ্জাবতী বানর অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি প্রাণী। বনের বাহিরে আসার অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো – এরা সাধারণত রোগাক্রান্ত হলে নিজেরদের সরিয়ে নেয় অন্যদের থেকে। তাই আমরা বন বিভাগের সহায়তায় এদের উদ্ধার করে, জানকীছড়া রেস্কিউ সেন্টারে রেখে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাসহ সেবা প্রদান করছি।”

তিনি বলেন, “লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করার পর লজ্জাবতী বানরগুলো ওই বনের সাথে খাপখাইয়ে নিতে পারছে কিনা এবং বনের স্থায়ী বাসিন্দাদের সাথে কোন প্রকার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে কিনা তা জানা এ গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া এক এলাকা থেকে উদ্ধার করা বানর অন্য এলাকায় ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগিয়ে ছাড়া হবে – কারণ এতে জানা যাবে নতুন পরিবেশে তারা কীভাবে টিকে থাকছে বা অন্য বানরগুলো সঙ্গে সম্পর্ক ও তাদের খাবার, প্রজননসহ ইত্যাদি বিষয়। পূর্বে যে বানরগুলো ছাড়া হয়েছে এর ভালো-মন্দ দিকও এখন জানা হবে।”

প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএন’র লাল তালিকায় সংকটাপন্ন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে লজ্জাবতী বানর। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী বাংলাদেশে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

“প্রাথমিকভাবে দুই বছরব্যাপী চলবে এই প্রকল্প, তবে প্রয়োজনে বাড়ানোও হতে পারে। যে ডিভাইস বানরের দেহে সংযুক্ত করা হবে সেটি এক বছর ৮ মাস থাকবে, এরপর খুলে পরে যাবে,” যোগ করেন হাসান আল রাজী। বলেন, “যেহেতু এই বানর টেরিটরিয়াল এবং একটা পুরুষ লজ্জাবতী বানর আরেকটিকে নিজ এলাকায় ঢুকতে দেয় না – তাই এই গবেষণায় বানরটির বৈশিষ্টগুলো জানতে চাই। জানতে চাই তাদের দেহে যে বিষ আছে তা একজন আরেকজনকে প্রয়োগ করছে কিনা। অবমুক্ত করা বানর স্থানীয় বানরদের ক্ষতি করছে কিনা বা স্থানীয়রা তাদের ক্ষতি করছে কিনা ইত্যাদি তথ্য জানা যাবে।”

গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানান, তাদের কাছে উদ্ধার হওয়া দুটি লজ্জাবতী বানর আছে। এর একটি ময়মনসিংহ থেকে পাচারের সময় উদ্ধার করা হয়েছিল। আরেকটি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত এ দু’টি বানর দিয়ে হবে গবেষণাটি। যেহেতু এগুলো সাতছড়ি বনের না, তাই গবেষণার জন্য এগুলোই যথেষ্ট সহায়ক।

বন্য পরিবেশে লজ্জবতী বানর বা লাজুক বানর। ছবি: হাসান আল রাজী।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্যমতে, বছরে গড়ে পাঁচটি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে সংস্থাটি। যেগুলোর বেশিরভাগই লোকালয়ে আসার পর আটক বা শিকার করে মানুষ। তবে প্রকল্পের গবেষকরা বলছেন, শ্রীমঙ্গলে ২০২১ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ১৩টি লজ্জাবতী বানর। এর মধ্যে দুটি বিদ্যুত স্পৃষ্টে মারা যায়।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক আব্দুল্লাহ আস সাদিক বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “শ্রীমঙ্গলে ইদানিং বেশি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করা হচ্ছে, যা গত দু’বছরের তুলনায় বেশ উদ্বেগজনক। আমাদের ধারণা, যেগুলো আমরা বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দিই সেগুলোই বারবার ফিরে আসছে লোকালয়ে। তবে ট্র্যাকিং ডিভাইস পদ্ধতির গবেষণাটি সম্পন্ন হলে জানা যাবে যে ছেড়ে দেয়া বানরগুলো নাকি নতুন করে আসছে লোকালয়ে।”

লজ্জাবতী বানরের স্বাস্থ্য পরিক্ষা করছেন গবেষকরা।

“আগে তো মনিটরিং ব্যবস্থা ছিল না। গত বছর ৫-৬টি বানর শ্রীমঙ্গলে পাঠিয়েছি, এর আগের বছরও পাঠিয়েছি। তবে আমরা উদ্ধারের পর রেসকিউ সেন্টারে পাঠাই, সেখানে কোয়ারেন্টিন শেষে বনে ছাড়া হয়। কিন্তু একটা সময় উদ্ধারের পরেই বনে ছেড়ে দেয়া হতো। যা এখন করা হচ্ছে না।”

লোকালয়ে আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এগুলো এখন ফ্রি-রেঞ্জিং হয়ে গেছে, কারণ প্রত্যেকটি প্রাণির আলাদা হোম রেঞ্জ থাকে। যেহেতু তারা সংখ্যায় বেড়েছে তাই বিচরণক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে চায়। ময়মনসিংহের দুর্গাপুরে লজ্জাবতী বানরের একটি বিচরণক্ষেত্র ছিল, সীমান্তের ওপাশে ভারতেও হেবিটেড ভালো, তাই হয়তো ওদিকেই বেশি মাইগ্রেট করছে তারা। তবে লজ্জাবতী বানর পাচার তথ্য নেই, যতগুলোই পেয়েছি সেগুলো লোকালয় থেকে উদ্ধার হওয়া। কিন্তু পাচারের বিষয়টিও আশঙ্কা আছে, যেহেতু ময়মনসিংহ সীমান্ত এলাকা। তবে যে ট্র্যাকিং হতে যাচ্ছে, এতে আসল কারণ জানা যাবে।”

Embed from Getty Images

বাংলাদেশ ফরেস্ট একাডেমির পরিচালক মোল্ল্যা রেজাউল করিম, যিনি গত কয়েক বছর বন্যপ্রাণী সার্কেলের বন সংরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন এবং গবেষণা কার্যক্রমটির দেখভালও করেছেন। তিনি বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “গবেষণায় দু’টি কাজ হচ্ছে- একটি ক্যানোপি ব্রিজ নির্মাণ ও আরেকটি স্লো লরিস বা লজ্জাবতী বানর কোথায় আছে, হেবিটেড কী, তাদের বায়োলজি ও প্রজনন ব্যবস্থা কেমন এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছে জার্মান প্রতিষ্ঠানটি, যা আমাদের দেশে আগে কোন কাজই হয়নি। আশা করছি এ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে, যা থেকে এই প্রজাতিটি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

“শুধুমাত্র বিভিন্ন লোকালয় থেকে উদ্ধার করা লজ্জাবতী বানরের ওপর গবেষণার অনুমতি দেয়া হয়েছে, বন থেকে ধরার সুযোগ নেই” যোগ করে মোল্ল্যা রেজাউল করিম বলেন, “এখন বছরে প্রায় সাত থেকে আটটিও লজ্জাবতী বানর উদ্ধার হয়।”

লজ্জবতী বানরের ইংরেজি নাম- বেঙ্গল স্লো লরিস/নর্দান স্লো লরিস/Bengal slow loris/northern slow loris বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম – ন্যাক্টিসেবাস বেঙালেনসিস/Nycticebus bengalensis; এটি লরিসিডি পরিবারের একটি বানর প্রজাতি। এ দেশের পাহাড়ি চিরসবুজ বনে বেশি দেখা যায় এদের, তবে আর্দ্র পত্রঝরা বনেও বসবাস করে এই প্রাণিটি। লজ্জাবতী বানর গাছের উঁচু শাখায় থাকতে পছন্দ করে।