এডিবি: পানের অযোগ্য মেঘনা নদীর পানি!

মেঘনা নদী। ছবি: ফারুখ আহমেদ, আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় দিনে গড়ে ৫০ কোটি লিটারের বেশি পানির যোগান দেয় মেঘনা নদী। অথচ দখল-দূষণে সেই নদীটির পানি এখন পানের অযোগ্য। এজন্য অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা ও আবাসিক প্রকল্পকে দায়ী করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। গেলো বুধবার ফিলিপাইনের ম্যানিলায় এডিবির প্রধান কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘মেঘনার সুরক্ষা: ঢাকার দীর্ঘস্থায়ী পানির উৎস’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে এভাবেই তুলে ধরা হয় মেঘনা নদীর চিত্র।

এতে নদীটিকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণার দাবিও জানায় এডিবি। ঢাকার প্রাকৃতিক টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ প্রকল্প নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে এডিবি। প্রকল্পটির জন্য বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা দেয় ব্যাংকটি।

এডিবির প্রতিবেদন বলছে, নারায়ণগঞ্জের বিশনাদ্দি ও হারিয়া পয়েন্টে পানি দূষণের মাত্রা ভয়াবহ। আর এই দুই পয়েন্ট থেকেই যোগান দেয়া হয় রাজধানীবাসীর ব্যবহার্য পানি। নদীতে ৪৫ ধরনের কীটনাশকসহ কাপড়ের রঙ, ভারী ধাতুর ৮৭টি নমুনা মিলেছে। ফলে নদীর পানি এখন পরিশোধনও অযোগ্য বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে। এই পানিতে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের বিস্তার ঘটানোর মতো উপাদানও রয়েছে, উল্লেখ করে এডিবি।

ইনফো-গ্রাফিক্স: বেঙ্গল ডিসকাভার

এ বিষয়ে নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “নদীর পানিতে ডায়াজিনন, ম্যালাথিওন ও কার্বোফুরানের মতো কীটনাশক মারাত্মক ক্ষতিকর। যে কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিশোধনাগারের মাধ্যমে পানি পানযোগ্য করতে বলেছে এডিবি।”

“এজন্য বছরে ১৭ কোটি ৫২ লাখ ডলার দরকার পড়বে, যা এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকার সমান। এতে পানি পরিশোধনে ঢাকা ওয়াসা’র খরচ অনেক বেড়ে যাবে,” উল্লেখ করেন মোহাম্মদ এজাজ।

“মেঘনার পূর্ব পাশের ৭৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৮ লাখ মানুষ বসবাস করে। এ এলাকা থেকে নির্গত হওয়া তিন লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্যও মিশছে পানিতে। নদীর পশ্চিম প্রান্তের দুই হাজার কারখানা থেকেও নির্গত হচ্ছে তরল বর্জ্য। এতে বাড়ছে নদীর পানি দূষণও,” উল্লেখ করে এডিবি।

এডিবি জানায়, মেঘনা নদী এলাকায় কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ারও পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। কারখানা স্থাপন করতে হারিয়া ইনটেক পয়েন্টে জমি ক্রয় করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তৈরি পোশাক শিল্প ও প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন কারাখানা স্থাপনে এ পর্যন্ত দেড়শ একর জমিও প্রস্তুত করা হয়েছে। বিশনাদ্দি ফেরি ঘাটে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের কাজ চলছে।

এডিবির মতে, এসব উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নদীর পানির মান আরো বিপর্যয়কর অবস্থায় যাবে। কাজেই পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা না করলে চর ভাসানি, চর দিঘলদি, নুনেরটেক, কালাপাহাড়িয়া ও নজরপুর এলাকার জীব-বৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে। দূষণে দক্ষিণ এশীয়ার বিলুপ্ত প্রায় নদীর ডলফিন, ইন্ডিয়ান রুফড টার্টলসহ কমপক্ষে ত্রিশ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির আশঙ্কা করছে এডিবি।

মেঘনা নদী। ছবি: ফারুখ আহমেদ, আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ

এডিবির অর্থায়নে প্রাকৃতিক টেকসই পানি সরবরাহ প্রকল্পটির উদ্যোগ নেয় হয় ২০১৩ সালে।

ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহমুদুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল সেটির ১৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। পাঁচ হাজার ২৪৮ কোটি টকার মধ্যে ৭৩৫ কোটি খরচ হয়েছে।

“পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়াতে প্রস্তাব ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে। পুনর্বিবেচনার পর প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে সাত হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে,” যোগ করেন এই প্রকল্প পরিচালক।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর অন্যতম মেঘনাকে ঘিরে বছরে ১৮ কোটি ২৯৩ লাখ ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে। তবে নদীর পানির মান কমে যাওয়া নিয়ে ঢাকা ওয়াসা ও স্থানীয় সরকার উদ্বিগ্ন বলে জানান মাহমুদুল।

তিনি বলেন, “যদি ঢাকার কাছের নদীগুলোর দূষণের মাত্রা কমনো সম্ভব না হয়, তবে মেঘনার পানির মানও উন্নত হবে না। সম্প্রতি তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা ও বালুসহ মেঘনার দূষণ রোধে জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।”

তবে গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “কেবল ইসিএ ঘোষণা করলেই মেঘনাকে বাঁচানো যাবে না, বর্জ্য পরিশোধনাগার-ইটিপি স্থাপনসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে তরল বর্জ্য পানিতে গিয়ে মিশতে না পারে।”