
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এতটাই ভয়াবহ যে এটি থমকে দিয়েছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বজুড়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে মানবজাতি। মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানবকুলে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব উঠেছে। এর থেকে কবে মুক্তি মিলবে, কখন স্বাভাবিক হবে কর্মপরিবেশ এবং সর্বোপরি কবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসবে মানুষ এসব দুশ্চিন্তাই ভর করছে খেটে খাওয়া মানুষের মনে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে এই ভাইরাসের বিস্তার শুরু। এ কারণে উহান শহরের সঙ্গে অন্য শহরগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ওই সময়ে উহান থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে হুয়াংগাং শহরও অবরুদ্ধ করা হয়। পরে এ বছরের ১১ জানুয়ারি করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে চীন। মুহুর্তেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস।
এ পরিস্থিতিতে ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা এড়াতে আক্রান্ত দেশগুলো নিজেরাই লকডাউনে যায়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দিক দিয়ে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব পরিস্থিতির এ সংকটময় মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই এদেশের মানুষের মধ্যেও ভর করেছে করোনা আতঙ্ক আর উদ্বেগ। এতো উৎকণ্ঠার মধ্যেই দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআর। এর দশদিন পর দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজন মারা যায়।

প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষকে ঘরে অবস্থান করার বিষয়টি নিশ্চিতকরণে রাজপথে, পাড়া-মহল্লায় প্রচার-প্রচারণা চালায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ। মানুষ খুব অহংকারী শিক্ষার দৌড়ে সে সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এখন সে নিজের শিক্ষা ব্যবস্থা নিজেই ঠিক করে নেয়। প্রকৃতিকে করে অস্বীকার। অথচ গুহাবাসী মানুষ একদিন প্রকৃতির কাছ থেকেই শিক্ষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলো। প্রকৃতির নিয়মগুলো তখন সে মেনে চলত। পরবর্তীতে যতই সে শিক্ষিত হয়েছে ততই সে নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে উঠেছে।
পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা শুধু তাত্ত্বিক শিক্ষাই দিতে পারে। প্রায়োগিক শিক্ষা নয়। প্রায়োগিক শিক্ষা পূর্ণ হয় প্রকৃতি শিক্ষায়। এদিক থেকে বিচার করলে আমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ। প্রকৃতির কাছে মানুষ শিক্ষা পেতে পারে দু’ভাবে। প্রকৃতির নিজের উপাদান অর্থাৎ পাহাড় পর্বত নদ নদী গাছ পালা আকাশ বাতাস প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে এবং প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত তারই অপর সন্তান পশুপাখি ও কীট-পতঙ্গের মাধ্যমে।
এখন দেখা যাক শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মানুষ কীভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা পেতে পারে। ছেলেবেলাতেই আমরা শিখেছি, একবারে না পারিলে দেখ শতবার। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে মাকড়সার কথা। অধ্যবসায়ের এই শিক্ষা আমরা কীট-পতঙ্গের কাছ থেকেই পেয়ে থাকি।

শুধু মানুষের নয়, সমগ্র জীবজগতেরই দৈহিক শক্তির সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু যখন দেখি অতি ক্ষুদ্র আকারের পিঁপড়ে তার দেহের ওজনের চেয়ে প্রায় ৫২গুণ বেশি ওজনের কোনো বস্তু নিয়ে দিব্বি চলাফেরা করছে। অথবা যখন দেখি গুবরে পোকার মত অতি সাধারণ এক পোকা তার শরীরের ওজনের প্রায় ৪৫০গুণ ভারি জিনিস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন কী আমরা প্রেরণা পাই না আমাদের দৈহিক শক্তির সীমাবদ্ধতা জয় করার?
স্থাপত্য শিল্পে পশু-পাখি এবং কীট-পতঙ্গরাও যে উৎকর্ষের পরিচয় দেয় তা দেখে অবাক হতে হয়। বাবুই পাখিকে বাসা বানানোর জন্য আলাদা করে কোনো প্রযুক্তি বিদ্যা শিখতে হয় না। সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারাই সে শিখে নেয় বাসা বানানোর প্রয়োগ কৌশল। শুধু বাবুই পাখি কেন অন্যান্য অনেক কীট বা প্রাণী, এমনকি পিঁপড়েরাও জানে নানা ধরনের সুন্দর সুন্দর বাসা বানানোর প্রযুক্তি। এসব প্রাণীদের অনেকেই মানুষের আগে পৃথিবীতে এসেছে। গুহাবাসী মানুষ কি এদের কাছ থেকেই বাসা বানানোর প্রেরণা পেয়েছিল।
খেলাধূলার ক্ষেত্রেও প্রকৃতি আমাদের শিক্ষাগুরু। হাঁস বা পানকৌঁড়ির সাঁতার কাটাই হয়তো আমাদের মানুষের সাঁতার শেখার প্রেরণা জুগিয়েছে। এর প্রেরণা যদি ডলফিনের কাছ থেকে আমরা পেয়ে থাকি তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আকাশে ওড়ার বাসনা তো পাখিদের দেখেই হয়েছিল আমাদের?
খুঁজলে হয়তো এরকম আরও অনেক উপমা পাওয়া যাবে যা আমাদের আরও অনেক নতুন নতুন ক্রীড়ার খোঁজ দিতে পারে। পিঁপড়ের কাছে আমাদের শেখার শেষ নেই। ওদের মত শৃঙ্খলাবোধ যদি আমাদের থাকতো তবে আমাদের জীবনের ধারাটাই পাল্টে যেত। একান্নবর্তী পরিবার কি করে রক্ষা করতে হয় তা ওদের কাছে শিক্ষণীয়। এ ব্যাপারে মৌমাছির নামও উল্লেখ করা যেতে পারে। মাথা ঠান্ডা রেখে কি করে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তার কৌশল এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলির বুদ্ধিতে এল কি করে ভাবলে অবাক লাগে।

বর্ষাকালে যখন এদের বাসা জলে ভেসে যায় তখন আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এরা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে গোল বলের মত দলা পাকিয়ে জলের উপর ভাসতে থাকে। সেই অবস্থায় ভাসতে ভাসতে কোনো উঁচু জায়গা পেলে অথবা জল কমে গেলে আবার এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ওদের দেখে শত্রু-মিত্র ভুলে গিয়ে যৌথভাবে আমরা বিপদের মোকাবিলা করতে পারি না কি। প্রকৃতির দেওয়া এই রক্ষা কবচ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। প্রকৃতির তৈরি নিয়ম-নীতি মেনে চললে একে রক্ষা করা আদৌ কোনো সমস্যা নয়।
মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য সন্তানদের নিয়ে প্রকৃতির কোনো মাথাব্যাথা নেই। কারণ তারা প্রকৃতি-জননীর সমস্ত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এমনকি অরণ্যের মানুষেরাও এটুকু বুঝতে পেরেছে যে প্রকৃতির বিপর্যয় মানে নিজেদের বিপর্যয়। এই সহজ সরল সত্যটা বুঝতে পারিনি শুধু আমরা, যারা আধুনিক কৃত্রিম শিক্ষার অহংকারে প্রকৃতির নিয়মগুলিকে মানতে অস্বীকার করি।
নিজেদের ভোগবিলাস চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রকৃতির অঙ্গে অনবরত দূষণ নামক ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছি। প্রকৃতির সারা অঙ্গে আজ এই ক্ষত। আর ভুল নয় প্রকৃতি যে পাঠদানের ব্যবস্থা করে রেখেছে, তাকে গ্রহণ করে প্রকৃতি মাকে রক্ষা করার শপথ নিই। আগামী দিনের স্লোগান হোক প্রকৃতি শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশ।