জলবায়ু পরিবর্তনে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ!

পুরো এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ।সবচে বেশি আক্রান্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। এজন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মানুষের প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দায়ী করছেন গবেষকরা।

ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিস প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি)-প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ডব্লিউএইচও জানায়, বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি, অর্থ্যাৎ ২৫০ কোটি মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে।

কেন এমন পরিস্থিতি?

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকৃতি ও প্রাণীকূল বিনষ্ট অন্যতম কারণ বলছেন গবেষকরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস মশার প্রজননের জন্য মাঝারি বৃষ্টিপাত এবং ২৭-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই যথেষ্ট। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোতে। সেই উষ্ণতায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গুরবাহক এডিস মশাও।

ছবি: সংগৃহীত

গবেষকরা বলছেন, মশা শিকারি ব্যাকটেরিয়া, কীট এবং প্রাণীও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। এর কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন, প্রকৃতি ও প্রাণিকূল বিনষ্ট এবং দূষণ।

বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ডা. এস এম মুনজুরুল হান্নান খান-এর মতে, ডেঙ্গুসহ অনেক ভেক্টরজনিত রোগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে জলবায়ু পরিবর্তন।

“বাংলাদেশে আবহাওয়ার প্যাটার্নের পরিবর্তনে বাড়ছে ভেক্টরজনিত রোগের প্রকোপ,” উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়াও এমন আরো রোগ বাংলাদেশে বিস্তারের আশঙ্কা করছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক কয়েকটি গবেষণায়ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডেঙ্গুর যোগসূত্রের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পাবলিক লাইব্রেরি অফ সায়েন্সে (পিএলওএস)’র তেমনই একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়।

এতে উল্লেখ করা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আগামী ৫০ বছরে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিতে পড়বে। এডিস এজিপটাই এবং এডিস এলবোপিকটাস- এ দু’টি সবচেয়ে সাধারণ রোগ-সংক্রমণকারী মশার মধ্যে ডেঙ্গু, জিকা এবং চিকনগুনিয়া-এনআইএরসহ এক ডজনের মতো ভাইরাস বহন করে। যা পরবর্তী আগামী ৫০ বছরে মানুষের জন্য বড় হুমকির কারণ হতে পারে।

শ্রীলংকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ছবি: সংগৃহীত

নেচার মাইক্রোবায়োলজি জার্নালের এক সমীক্ষার বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন আরো বাড়িয় তুলতে পারে ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তারকে। কারণ গরমের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে ডেঙ্গু মশা আরো বেশি এলাকা জুড়ে ছড়াবে, যা আগে পারে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা ডেঙ্গু মশাকে দ্রুত প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে কামড়াতে সহায়তা করে এবং সেই মশা রোগ বহন ও ছড়িয়ে দেয় দ্রুত।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহফুজুল হক বলেন, “আগের বছরগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতটা তীব্র হয়ে ওঠেনি। তবে ঝুঁকি তখনই বাড়ে যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়।“

বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু। ছবি: সংগৃহীত

মশা নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।

তিনি বেঙ্গল ডিসকাভার-কে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে শুধু মশা নয়, অনেক জীবেরই সম্পর্ক রয়েছে। মশার ক্ষেত্রে বললে, ১৯৫৩ সালের পরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর সঙ্গেই এডিস মশার একটি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টারেস্টিক যুক্ত। এ মশার ডিম শুকনা অবস্থায় ৬ মাস থাকতে পারে। এর মধ্যে ডিমটা নষ্ট হবে না।

“আগের বছরের ডিম অর্থাৎ অক্টোবর মাসে যে ডিমটা এডিস মশা ছেড়েছে এর চারমাস পর যখন ফেব্রুয়ারিতে পানি পেয়েছে তখন এডিস মশার বড় গ্রুপ ঢাকা শহরে জন্ম হয়েছে। এরপর মার্চ-এপ্রিল মাসে যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হলো তখন এডিস মশার বিস্তার বা সংখ্যাটা বেড়ে গেল ব্যাপকভাবে,” উল্লেখ করেন গবেষক।

এডিস মশার ঘনত্ব মাত্রায় বেড়েছে, যা আগেই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, জানান অধ্যাপক কবিরুল বাশার। বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে বছরে ঢাকা শহরে তিনটি সার্ভে হয়। চলতি বছর ৯৮টি ওয়ার্ডে ১০০টি স্থানে জরিপে দেখা যায় ঘনত্ব ২০ এর ওপরে ছিল।

ডেঙ্গু বহনকারী মশা থেকে মুক্তির উপায় কী?

দক্ষিণ এশিয়ার তাপমাত্রা এডিস মশা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট যুতসই। আপাতত স্বল্প মেয়াদে উড়ন্ত মশা নিধনে উদ্যোগ নিলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রিডেটরের ভূমিকা কম। কারণএই মশা ঘরের বালতি, ড্রাম, টায়ার বা জমানো পানিতে বেশি সৃষ্টি হয়। তাই নাগরিকদের সচেতন হওয়ার কোন বিকল্প নেই।

“আর প্রাকৃতিক জলাশয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জুপ্লাংটন, ফাইক্লস, কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে,” বলেন কবিরুল বাশার।