
জানতে চাইলে সবাই একবাক্যে বলবেন পাহাড় আমাদের একমাত্র আকর্ষণ। আমাকেও পাহাড় টানে, তবে নদী টানে আরও বেশী। নদীর অজানা ও রহস্যময় টান সব সময় অনুভব করি। পাহাড়ে গেলেও সে টান সঙ্গে করে নিয়ে চলি। গত বছর জানুয়ারীর গল্প। মহানদী মেঘনায় ভেসে চর কুকরিমুকরি যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বোরহানুল হক সম্রাট, প্লাবন রহমান, ফারাবী হাফিজ ও শরীফ নীড়কে সঙ্গে করে সম্রাট ভাইয়ের পরিকল্পনায় পাহাড় আর হ্রদের বাড়ি কাপ্তাই চলে যাই।
নদীতে এখন আর মাল্লারা গুন টেনে চলে না, রঙিন পাল তোলা নৌকা চোখে পড়ে না। তবু নদীর জন্য কিছুটা মন খারাপই হল। সে মন খারাপ অবস্থায় সকালে রওনা দিয়ে রাতে উঠলাম কাপ্তাই বন বিভাগের বিশ্রামাগার বনফুলে। বনফুলের সেই রাত কেটেছিল দারুণ। সে জন্য সব সময় বলতে পারি বনফুল আমার ভালো লাগার আরেক নাম।

একরাত এখানে ছিলাম বলেই ভালো লাগা পূর্ণতায় রূপ নিয়েছিল। সে রাত ভোরে ঘুমাতে যাবার আগে পরিকল্পনা হয় আমরা কর্ণফুলী নদীতে ভেসে কাপ্তাই ফরেষ্টে যাবো। দেখবো একশ বছরের বেশী পুরাতন কাপ্তাইমুখ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউস, ঘুরে দেখবো পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ বন বিভাগের কিছু অংশ!
আমাদের ঘুম ভাঙ্গে সকাল নয়টায়। দরজা খুলে বেলকনিতে যেতেই দুচোখ ছানাবরা। সবুজ গাছগাছালি পেরিয়ে কয়েক হাত দুরত্বে আঁকাবাঁকা কর্ণফুলি নদী। আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, মুগ্ধ। মুগ্ধ বিস্ময় আরো অপেক্ষা করছিল, যা পড়ে বুঝেছি। চর কুকরিমুকরি না গিয়ে সবার পছন্দে কাপ্তাই গিয়ে সেখানে প্রকৃতির ঐশ্বর্যের যে নাগাল পেয়েছিলাম, সে গল্পই আজ শোনাবো।

কাপ্তাই বনবিভাগের বনফুল রেষ্ট হাউস থেকে প্রবাহমান কর্ণফুলী হাত ছোঁয়া দুরত্বে। কর্ণফুলীর রূপ সৌন্দর্য বুকে ধারণ করে বের হলাম বনবিভাগের জীপ গাড়িতে, যাবো বনবিভাগের কর্ণফুলী রেঞ্জে। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের ল্যান্ড রোভার। কর্ণফুলি রেঞ্জে যাবার রাস্তা কাপ্তাইর অন্য সব রাস্তা থেকে একটু আলাদা। দুর্গম না হলেও বন্ধুর। ২০ মিনিটে আমরা সে বন্ধুর পথ ধরে কর্ণফুলী রেঞ্জে চলে এলাম। এখানে নদীর পাশে ফরেষ্ট অফিস, বনকর্মীদের কোয়ার্টার, ডরমেটরি ও ক্যান্টিন। সবই বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শীতের মিষ্টি রোদ। সবুজ পাহাড়। পাখিদের কিচিরমিচির শেষে একঝাঁক নৌকা। সেই হাঁটা পথ ছিল ১০ মিনিটের।
কর্ণফুলীর তীরে আগে থেকেই তৈরী ছিল বন বিভাগের বজরা। আমরা সে বজরায় সওয়ার হলাম। বজরা যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যে নদী আর পাহাড় থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস হাত-পা জমিয়ে দিচ্ছিল। আমরা বজরার ছাদে গিয়ে বসলাম। সূর্যের উষ্ণ পরশ শরীরে আরাম দিলো আর চোখে আরাম দিলো ফ্লাইং ফিস বা উড়ুক্কু মাছ। আমাদের বজরার সঙ্গে সঙ্গে উড়ুক্কু মাছ গুলোর ছুটে চলা দারুণ উপভোগের বিষয় হল। ক্যামেরার ক্লিক চললো কর্ণফুলীর মতই একটানা। এভাবেই কর্ণফুলীর জলে উড়ুক্কু মাছ আর চারিপাশের সবুজ বৃক্ষরাজিতে চোখ জুঁড়িয়ে ঠিক দেড়ঘন্টা পর লম্বা সিঁড়ির যে ঘাটে পৌঁছি সেটা কাপ্তাইমুখ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউস।

পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধিন কর্ণফুলী রেঞ্জের এই রেষ্ট হাউসটি সবচেয়ে পুরাতন বা প্রাচীন। এর নির্মাণ সাল ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দ। সে হিসাবে রেষ্ট হাউসটির বয়স ১১২ বছর। কর্ণফুলি নদীর পাশে সুন্দর ছবির মত বন বাংলো। যেখানে লোকবল মাত্র পাঁচজন। বিশাল বন সম্পদ রক্ষায় মাত্র পাঁচজন লোক ভাবতেই অবাক হলাম। দুর্গম পাহাড়, কর্ণফুলি নদী, বনের হিংস্র জীবজন্তু ও বনদস্যুদের এ পাঁচজন এমন এক জায়গায় বসে মোকাবেলা করেন যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই, তারপর আছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ।
বনরক্ষী পাঁচজনের সঙ্গে আমরা প্রাচীন বন বাংলোয় পদরেখা ফেলি। তারপর আরাম সোফায় গা এলিয়ে গল্পে মেতে উঠি। যার পুরোটাই কাপ্তাই ফরেষ্ট ও এখানকার বুনো হাতি আর হরিণ, শুকর, বানর, বন মোরগ আর কর্ণফুলি নদীর। বনরক্ষীদের মুখে সবচেয়ে বেশী শুনি বুনো হাতির গল্প। এই বনে প্রচুর হাতি রয়েছে। দিনের বেলা কখনো কখনো দেখা গেলেও রাতেই বেশী চোখে পড়ে।

গেলো রাতেও আটটি হাতি পুরো বাংলোর চারপাশে চক্কর লাগিয়েছে। হাতি চক্করের কথায়, প্লাবন এর প্রশ্ন-ভয় করে না? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভয় করে না আবার! ভয়ে আত্মারাম খাঁচা থেকে বের হয়ে যায়। সারারাত উপরওয়ালার নাম নিই, আর ভোর হওয়ার অপেক্ষা করি। এক সময় দিনের আলো ফোটে, আর হাতিরাও কোনো রকম তান্ডব না চালিয়ে চলে যায়, আমরা হারাই ঘুমে। এরমধ্যে একজন বনরক্ষী বলেন, কিছু ব্যাপার মনে হয় গড গিফটেড। বনের প্রাণীরা কখনো ফরেষ্টের কারো ক্ষতি করেনি। তবু মানুষ বলে কথা, ভয় চলে আসে!
আমাদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা ছিল। ক্ষিধাও লেগেছিল। নাস্তা করে বের হই জঙ্গলে। কাপ্তাইমুখ রেষ্ট হাউস ও বন এলাকার বেশীর ভাগ যায়গায় বন কর্মকর্তা ছাড়া কোনো মানুষের পদচিহ্ন সেভাবে পড়েনি। এখানে সবুজ পাহাড়ের কোলে বিশাল সব গাছের ছায়ায় পুরো বনপথ অন্ধকার হয়ে থাকে সারাক্ষণ। সেই ছায়া ঢাকা পথ ধরে আমরা চারজন সামনে এগোই।

চলতি পথে পরিত্যাক্ত হরিণ প্রজনন কেন্দ্র ঘুরে দেখি। এখানে রয়েছে বাংলাদেশ বন গবেষনা ইন্সস্টিটিউট। সেটাও পরিত্যাক্ত। এই জায়গাটুকু বাদ দিলে পুরোটাই ১২০০ একরের বিশাল বন। বোরহান ভাই হাতির টাটকা পায়ের ছাপ দেখে ছবি তুলে নেয়।
শরীফ হরিণের পায়ের খোঁজ না পেয়ে হতাশ হয়। ফারাবীর হতাশা আরো বড়। একটু পর পর ঘন ঘাসবনের দেখা মিলছিল। ঘাস বন নড়ে না এখানেই তার হতাশা। একটা এশিয়াটিক বাফেলো মানে বুনো মহিষ সেই ঘন ঘাসবনে দেখবার খুব ইচ্ছে ছিল তার।

আমরা প্রায় দেড়ঘন্টা কাপ্তাই ফরেষ্টের কিছু অংশের বৈচিত্রের খোঁজে গহীন অরণ্যে ঘুরে বিশাল সব গাছ বানর ও চশমাপড়া হনুমান দেখে যখন কর্ণফুলি নদীর দিকে এগিয়ে চলি তখন বিকেল পাঁচটা। কাপ্তাইমুখ বনে রাতে থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফারাবী আর শরীফ নীড়ের হাতি ভীতির কারনে আমরা ফিরে চলি বনফুল বিশ্রামাগারে।
আমরা হাতি দেখিনি তবে সবুজ বনে ছুটে বেড়িয়েছি। আমরা উড়ুক্কু মাছ দেখেছি আর ছুঁয়ে এসেছি শতবর্ষের কাপ্তাইমুখ বনবাংলো-সব মিলিয়ে কাপ্তাইমুখ রেষ্ট হাউস আমাদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ফিরতে ফিরতে স¤্রাট ভাই সবার কাছ থেকে কথা নিলেন, আবার আসবো কর্ণফুলিতে জাল দিয়ে উড়ুক্কু মাছ ধরবো আর কাপ্তাইমুখ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউসে রাত্রিযাপণ করবো হাতির অপেক্ষায়!
লেখক: নদী সংরক্ষকর্মী ও আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ