ঢাকার পাঁচ নদী ও ১৭ খালের পরিণতি!

ছবিটি সংগ্রহীত

‘রামগঙ্গা’ ও ‘নারায়ণীগঙ্গা’ নামে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী দুটি নদীর নাম উল্লেখ আছে ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে। এতে বলা হয়- ”ঢাকা জেলার বক্ষদেশে রামগঙ্গা ও নারায়ণীগঙ্গা উপবীতবৎ (উপকণ্ঠে) শোভা পাইতেছে”। কিন্তু এর ঠিক একশো বছর পর নদী দুটি চিরতরেই অপরিচিত এ জনপদের মানুষের কাছে।

টেমসের তীরে লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, দানিয়ুবের তীরে বুদাপেস্ট। তিন নদী এ তিন শহরকে বিশ্বে দেশগুলোকে পরিচিত করলেও রাজধানী ঢাকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের পৃথক দুটি জরিপ থেকে জানা গেছে, স্বাধীনতাকালেও ঢাকা জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ১৫টি। এর মধ্যে আঁটি, কনাই, দোলাই, পান্ডো ও নড়াই- এ পাঁচ নদীর কোনো হদিস এখন নেই। একইসঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও টঙ্গী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১৭টি খালও হারিয়েছে। মহানগরী এলাকায় এক সময় খাল ছিল ৭৫টি।

কোথায় গেল ঢাকার নদীগুলো?

গত কয়েক দশকে একের পর এক দখল-দূষণে নদী ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে শহর ও সুরম্য অট্টালিকা, তৈরি হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র, মার্কেটসহ নানা স্থাপনা। অর্ধশত বছরে এসব নদী ও খালের বুকের ওপর গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা।

ইতিহাসের গ্রন্থে বলা হয়েছে, মোগল আমলেও পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ থেকে পূর্বে বালু নদীতে প্রবাহিত হতো নড়াই নদী। আজকের ধানমন্ডি লেকের পশ্চিমমুখী দুই বাহু আসলে নড়াই নদীর দুই ধারা। কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ আছে- পিলখানা হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশে যাওয়া ধারাটি ছিল পান্ডো নদী। আর এখনকার মোহাম্মদপুর হয়ে তুরাগে মেশা ধারাটি ছিল নড়াই। ঢাকায় আরেকটি নদীর নাম ছিল সোনাভান। এ নদীটি তুরাগ থেকে মিরপুর এলাকার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর কাছে তুরাগের সঙ্গেই মিলিত হতো।

গবেষণা প্রতিবেদন

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, পান্ডো নদীর অবস্থান ছিল ধানমন্ডির ঈদগাহ মসজিদ থেকে মোহাম্মদপুরের কাটাশুর পর্যন্ত। নড়াই নদীর অবস্থান ছিল বালু নদী থেকে বর্তমান কারওয়ানবাজার জামে মসজিদ পর্যন্ত। হারিয়ে যাওয়া আঁটি নদীর অবস্থান ছিল বর্তমান বছিলা ব্রিজ থেকে আঁটিবাজার পর্যন্ত। টঙ্গী নদী থেকে উত্তরা ও আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ছিল কনাই নদীর অবস্থান। আর দোলাই নদীর অবস্থান তেরমুখ থেকে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল পর্যন্ত ছিল। নদীটি একসময় মারা গেলেও এটি ধোলাইখাল হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে কালের পরিক্রমায় দখল-দূষণে সেই ধোলাইখালও মৃতপ্রায়।

একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো সংযোগ করেছিল রাজধানীর প্রধান চারটি নদীকে। সূত্রাপুর-লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত-ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল এসব খাল।

বুড়িগঙ্গা নদী। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকার আশপাশে দশটি নদী বহমান থাকলেও দখল-দূষণে তা মৃতপ্রায়। অনেক নদী শুষ্ক মৌসুমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে দখলদাররা নদীতে মাটি ভরাট করে বানিয়েছে অট্টালিকা। কোথাও কোথাও নদীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। এর বাইরে কল-কারখানার রাসায়নিক বজ্য, পয়োবর্জসহ নানা কারণেই নদী দূষিত হচ্ছে। ফলে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে নদীর গতিপথ।

নদী আর খাল দখলের প্রভাব পড়েছে রাজধানীর জীবনযাত্রায়। অল্প বৃষ্টিতেই সড়কগুলো রূপ নেয় জলাশয়ের। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা থাকছে দিনের পর দিন। ঢাকার আশপাশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে সামান্য বন্যায়। কেবল নদী আর খালই নয়, বিলীন হয়েছে রাজধানীতে থাকা অসংখ্য পুকুরও। গত ৯৬ বছরে পুরান ঢাকার ৯৬টি পুকুর বিলীন হয়ে গেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আদি ঢাকার পুকুর নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার। এতে ১৯২৪ সালের টপোগ্রাফি মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

নদী গবেষকদের ভাষ্য

“ব্রিটিশ আমলে ঢাকার সীমানা ছিল অনেক ছোট। মানচিত্র অনুসারে তখন ঢাকা বলতে উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে চর ইউসুফ ও চরকামরাঙ্গী, পশ্চিমে ধানমন্ডি এবং পূর্বে মতিঝিল ও ইংলিশ রোডের মধ্যবর্তী এলাকাকে বোঝানো হতো। এই ছোট এলাকার মধ্যেই ছিল ১২০টি পুকুর। সেই সংখ্যাটা এখন মাত্র চব্বিশে এসে দাঁড়িয়েছে। আদি ও নতুন ঢাকা মিলিয়ে বর্তমানে পুকুর রয়েছে মাত্র ২৪১টি। ধর্মীয় উপাসনালয়ের সঙ্গেই আছে ৪৩টি। এর বাইরে ৮৬টি বিল ও লেক রয়েছে। পুকুর, বিল ও লেক মিলিয়ে জলাশয়ের সংখ্যা ৩২৭টি,” জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।

তিনি বলেন, ”নদী ও খালগুলো দখলের পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ণের দায়। উত্তরা, বনানী, বনশ্রী, নিকুঞ্জসহ বড় বড় প্রজেক্টগুলো তৈরির সময় কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এতে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ রাখা হয়নি। বৃষ্টির পানি পুন:ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল। শহরের মাইলের পর মাইল হাঁটলেও এখনো মাটি পাওয়া যায় না। ফলে পানি ‍পুন:ব্যবহারের সুযোগ নেই।”

মোহাম্মদ এজাজের ভাষ্য, ”ঢাকা ও তার আশপাশের গত ৫০ বছরে পাঁচটি নদী হারিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নষ্ট করেছি। এরপর আবার বেড়িবাঁধের দুপাশেই দখল করা হয়েছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর অনেক শাখা নদী ছিল, সেগুলো দখল হয়ে গেছে। আর নদী হারিয়ে যায় তখন চেষ্টা করলেও নদীকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কষ্টকর।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের মতে, ”নদীর ঢাল, পার ও প্লাবন অঞ্চল সব দখলদারদের কাছে দিয়ে তলদেশকে গভীর করে নৌ চলাচল ও বর্জ্য নিষ্কাশনের রাস্তা তৈরি করেছে সরকার। আমাদের নদীগুলোকে রক্ষা করতে হলে নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের যে পরিকল্পনা তা জনসম্পৃক্ত করতে হবে, স্বচ্ছতা ও বিজ্ঞানসম্মত করাসহ অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।”