সাধারণত মানুষ থেকে দূরে থাকে, নয়তো ভয় পেয়ে মানুষের দিকে তেড়ে আসে বন্যহাতি। কিন্তু এই প্রথম মানুষের কাছাকাছি থাকছে কাদায় আটকে আহত হওয়া বন্যহাতি। মানুষ দেখলেই ধীরে ধীরে ছুটে আসছে, গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। নিজের জীবন বাঁচাতে জানাচ্ছে যেন প্রবল আকুতি!
করবেই না বা কেন? গেল ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা বাগানের জামিলাবাগ এলাকা থেকে এই মানুষেরাই তো কাদা থেকে উদ্ধার করে হাতিটির জীবন বাঁচিয়েছিল। বন বিভাগের কর্মকর্তারা তাই এই বুনো মহিলা হাতির নাম দিয়েছে- ‘জামিলা’। তবে উদ্ধারের ১১ দিন পার হলেও শারীরিক উন্নতি হয়নি বুনো হাতি ‘জামিলা’র।
চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে প্রাণীটির জীবন রক্ষার চেষ্টা করছে বন বিভাগ। কিন্তু কোথায় বা কীভাবে হাতির শারীরিক অসুস্থতা নির্ণয় ও সেবা-শুশ্রুষা দেয়া হবে তা নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌছুতে পারেননি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতে বিলম্বিত হচ্ছে হাতির উন্নত চিকিৎসা। এদিকে বন্যহাতি ‘জামিলা’র শারীরিক অবস্থা জানিয়ে ১০ মে বন অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কোদলা বন বিট অফিস।
ফরেস্টার নবীন কুমার ধর স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “উদ্ধারের পর হাতিটিকে কলা গাছ, বরবটি, ধান গাছ, আনারস, পাকা কলা, ঘাস ও লতাপাতাসহ সরবরাহ করা পানি নিজ শুঁড় দিয়ে গ্রহণ করেছিল হাতিটি। কিন্তু পরবর্তীতে খাবার গ্রহণ ও পানি পান করা থেকে বিরত রয়েছে হাতি জামিলা এবং প্রতিনিয়ত স্বল্প পরিসরে বৃত্তকারে ঘুরছে। তাই বন্য এই হাতির জীবন রক্ষায় বিশেষজ্ঞ প্রাণীবিদ ও চিকিসৎকদের সমন্বয়ে দ্রুত মেডিকেল টিম গঠন করে অনতিবিলম্বে হাতিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজন।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, উদ্ধারের পর হাতির পিঠে থাকা ক্ষতে পোকা ছিল। সাম্প্রতিক চিকিৎসায় তা সেরে উঠেছে ও ক্ষত শুকিয়েছে। আর খাবার না খাওয়ায় এ কদিন স্যালাইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। এতে কিছু শক্তি পেয়ে অল্প চলাফেরা করছে হাতিটি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে কোন খাবার এমনকি পানিও মুখে তুলতে পারছে না বন্য এই হাতি। এতে আবারো দুর্বল হবার আশংকা রয়েছে। যা হাতিটির জীবনহানি করতে পারে।”
ইআরটি’র সদস্যরা ও বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাতিকে পালা করে পর্যবেক্ষণ করাসহ সেবা-শুশুষা দিচ্ছেন। গত ১১ দিন ধরে অসুস্থ হাতির সেবা করা ইআরটি’র সভাপতি আব্দুল করিম বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “হাতিটিকে আমরা পাহাড়া দিয়ে রেখেছি। তাকে নিয়মিত খাবার ও পানি দিচ্ছি। কিন্তু সে খেতে চাইলেও খাবার গিলতে পারছে না। আমাদের ধারণা হাতির গলায় কোন অসুখ রয়েছে।”
ইআরটি’র সদস্য আব্দুল নবী বলেন, “হাতিটিকে আমরা লবনের পানি ও স্যালাইন খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি। এরপর কিছুটা উঠে দাঁড়িয়েছে। এখন এটিকে বাঁচাতে দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দরকার।”
১১ মে সকালে বন বিভাগের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে হাতির শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বন্যপ্রাণী অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম, বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক উপপ্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে, কোদালা বন বিটের ফরেস্টার নবীন কুমার ধর এবং স্থানীয় এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম-ইআরটি’র সদস্যরা।
যেহেতু এটি বন্যহাতি তাই যেখানে আছে সেখানেই হাতিটি সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পরামর্শ দিয়েছেন বন বিভাগের প্রাণী চিকিৎসক ডুলাহাজরার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভেটেরিনারিয়ান মুস্তাফিজুর রহমান।
হাতির উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম। তিনি বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “হাতিটিকে কোন পদ্ধতি বা কোথায় চিকিৎসা দেয়া হবে তা আমরা এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। আমরা স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে দেখলাম। এটা দেখার পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী সিন্ধান্ত নিব। আশা করি আমরা হাতিটিকে বাচিয়ে রাখতে পারবো।”
কোদালা চা বাগান ভেতর যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়াতে হাতির দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা নিয়ে প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বন বিভাগ বন ভেতর কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এটি দুর্গম এলাকা হলেও আমাদের যা সক্ষমতা আছে তা এনে হাতিটির চিকিৎসা করবো।”
বন বিভাগের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, গেল কয়েক দিন ধরে হাতির পাল কয়েক দফায় এসেছিল হাতিটিকে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু দুর্বল হওয়ায় হাতি যায়নি এবং তারা নিতেও পারেনি। এ বিষয়ে ফরেস্টার নবীন কুমার ধর বলেন, “হাতিরা পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে চলাচল করে থাকে। এখন এটি যদি শারীরিকভাবে সুস্থ না হয় তবে হাতির পাল এই হাতিটিকে গ্রহণ করবে না, এমনকি পাল থেকে বেরও করে দিয়ে থাকে।”
“তবে এই হাতিটিকে সুস্থ করে গলায় রেডিও কলার বা চিপ দিয়ে পালের মধ্যে পাঠানো গেলে এ অঞ্চলের বন্যহাতিদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যেতে পারে” যোগ করেন নবীন কুমার ধর।
হাতিটিকে উদ্ধারের পর চিকিৎসা দেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন সৈয়দ হোসেন। তিনি বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “আমি দেখেছি হাতিটি অনেক দুর্বল। তাই অচেতন করে অন্য কোথাও নিয়ে চিকিৎসা দেয়া ঠিক হবে না। কারণ এ অবস্থায় অচেতন করলে দুর্বলতার কারণে হিতে বিপরীত হতে পারে। আর হাতিটি কেন খেতে পারছে না, তা নির্ণয় করা প্রয়োজন এবং পাশাপাশি স্যালাইন দিয়ে শারীরিক অবস্থার উন্নতি করা যেতে পারে।”