সাপ গবেষণায় মিললো চাঞ্চল্যকর তথ্য

ইনি সাপ/হেলে সাপ। ছবি: আদনান আজাদ আসিফ, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী. বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাপ বিষয়ক এক গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য-উপাত্ত। সঠিক তথ্যের অভাবে সাপ নিয়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণায়। এতে জানা যায়, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ মানুষকে আক্রমণ করে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পরিচালিত ”স্টুডেন্ট পারসেপশন অন স্নেইক ইন নর্থওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ” শীর্ষক গবেষণা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গবেষণাটি ’এশিয়ান জার্নাল অব এথনোবায়োলজি’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রধান গবেষক ছিলেন বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, সহযোগী গবেষক ছিলেন বিভাগের শিক্ষক মাহাবুব আলম, প্রধান সহকারী গবেষক ছিলেন মো. ফজলে রাব্বী। সহকারী গবেষক হিসেবে অংশ নেন বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক সরকার, আফজাল হোসেন এবং আশিকুর রহমান সমীসহ বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা।

সবুজ বোড়া সাপ। ছবি: আদনান আজাদ আসিফ, বন্যপ্রাণী গবেষক, বাংলাদেশ।

সাপ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণার ওপর বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এতে রাজশাহী, রংপুর এবং নাটোর অঞ্চলের সাতটি বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। ২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই গবেষণা সম্প্রতি শেষ হয়। যা বাংলাদেশে প্রথম সাপ বিষয়ক গবেষণা হিসেবে উল্লেখ করেছে ঢাবির প্রাণীবিদ্যা বিভাগ।

গবেষণায় জানা গেছে, ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ ক্ষতিকর প্রাণী, ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হয়। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ মানুষকে আক্রমণ করে। ৯২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ এলাকায় সাপ মারতে দেখেছে, ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেরাই সাপ মেরেছে আর ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সাপ মারার মাধ্যমে আনন্দ পায়।

গবেষণা চলাকালে শিক্ষার্থীরা সাপ সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ধারণা উল্লেখ করে। তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের মণি আছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীরা জানায় সাপুড়ের বীনের তালে সাপ নাচে। সাপ দুধ খায় কিনা এই প্রশ্নে ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীরা মনে করে সাপ দুধ খায়। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সাপ কোন ধরনের তরল খাদ্য গ্রহণে অক্ষম। আরো বিস্ময়কর তথ্য হলো, ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীরা মনে করে সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে।

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ১০৫ প্রজাতির সাপ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ৮২ প্রজাতির সাপের সন্ধান মিলেছে।

প্রধান গবেষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, সাপ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে সরীসৃপটি সংরক্ষণে জন্য উদ্বেগজনক। মানুষের আবাসস্থলের আশেপাশে বসবাসকারী সাপের মধ্য দুই প্রজাতির গোখরা, কালাচ, শঙ্খিনী ও চন্দ্রবোড়া বিষধর সাপ হিসাবে বিবেচিত হয়। এরমধ্যে শঙ্খিনী অন্য বিষধর সাপ খেয়ে থাকে এবং মানুষের ক্ষতি করার কোন তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

”যদিও সাধারণের ধারণা সাপ মারলে তার সঙ্গী প্রতিশোধ নিতে আসে তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সাপ মারলে তার সঙ্গী প্রতিশোধ নিতে না আসলেও পরিবেশের যে ক্ষতি হয় তাতে মানুষ ক্ষতির শিকার হয়। সুতরাং সাপ মারলে যে এলাকায় পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে মানুষ বিপদ ডেকে আনে এতে সন্দেহ নেই,” উল্লেখ করেন গবেষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ।

সাপ গবেষণা প্রকল্পটির ব্যানার। ছবি: প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সহযোগী গবেষক মাহাবুব আলম বলেন, মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় সময় যে দিকটির বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল তা হলো- জনগণের মধ্যে সাপ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, সাপ-দংশন, চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজারসহ জন সমাগমের স্থানে জনগনকে নিয়ে আলোচনা সভা করা হয়। যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাপ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা হয়।

”পাশাপাশি কীভাবে মানুষ-সাপ সংঘর্ষ থেকে উভয়কেই রক্ষা করা যায় তা জানানো হয়। যা সাধারণ মানুষ সাদরে গ্রহণ করে। মানুষের মনে সাপ আতঙ্ক কমলে এবং কুসংস্কার দূর হলে মানুষ যেমন মৃত্যু থেকে রক্ষা পারে তেমনিভাবে বেঁচে থাকবে সাপও। রক্ষা পাবে নির্বিষ সাপ, যারা পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা করে, উল্লেখ করেন গবেষক মাহাবুব আলম।

প্রধান সহকারী গবেষক ছিলেন মো. ফজলে রাব্বী বলেন, সাধারণত সাপের প্রাকৃতিক আবাসস্থল নষ্ট, খাদ্যের অভাব, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ইত্যাদি কারণে সাপ মানুষের আবাসস্থলে বিচরণ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মরক্ষার্থে মানুষকে দংশন করে। অনেক সময় বিষহীন সাপের কামড়েও মানুষের মৃত্যু হয়। মূলত সাপ ভীতির কারণে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান অনেকেই। ওঝা দিয়ে সাপের বিষ নামানোর নামে ভুল চিকিৎসায়ও মারা যায় সাপে কাটা রোগী।