গণেশ ঠাকুর আমার ভীষণ প্রিয়, বোধহয় ওই মাথাটি হাতির বলে বড় সুন্দর লাগে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় চিত্রশিল্প, সাহিত্যে হাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। সেটা যেমন বেদ, পুরাণ, রাজা-রাজরার ইতিহাসে তেমনি দৈনন্দিন যাপনের চিত্রেও। ভারতের বেশীরভাগ মন্দিরগাত্র ও দ্বারে হাতি খোদিত আছে বা হস্তী মূর্তি আছে। কোনারক, মহাবলীপুরম, এলিফ্যান্টা, ইলোরার কৈলাশ মন্দির, বেলুড়- এ সমস্ত জায়গার হস্তীমূর্তি জগদ্বিখ্যাত। হিন্দু বহু দেবদেবীর বাহনও হাতি যেমন- বিশ্বকর্মা, কোনো কোনো জায়গায় দেবী দুর্গার বাহন হিসেবেও হাতিকে দেখা যায় অর্থাৎ ভারতীয় জীবনে হাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমার প্রথম হাতি নিয়ে পড়া গল্প হল লীলা মজুমদারের “যাত্রামঙ্গল” সেখানে যাত্রামঙ্গল যেমন ভীষণরাগী একটি পুরুষ হাতি তেমনি কুসুমকলি ভারী শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে হাতি। এ গল্প ছেলেবেলায় হাতি সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে দেয়। পরবর্তীতে যে হাতিটি মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল সে হল “আদরিণী”। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বড় যত্নে সেই হস্তিনীর কথা লিখেছিলেন যার ভালোবাসার আবেগ, বিদায়ের চোখের জল হাতিকে আমাদের পরিবারের আর পাঁচজন সদস্যের মত আপন করে দেয়।
কলেজে পড়াকালীন দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বনে ঘোরার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাবার চাকরিসূত্রে ডুয়ার্স ও বেড়ানোর সূত্রে বাঁকুড়া, বিহার, ঝাড়খন্ড বা অন্যান্য জায়গায় বেশ কাছ থেকেই বন্য হাতি ও পোষা হাতি দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু কথা বলি- আমি তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, টপস্লিপে প্রথম ট্রেকিং…
আমাদের গাইড নটরাজন (আমার দেখা একজন জঙ্গলকে ভালোবাসার অনন্য মানুষ)। আমার সেইসময় চকলেট খাবার বদঅভ্যেস ছিল। আমি একের পর চকলেট খাচ্ছি আর জঙ্গলে ফেলা র্যাপারগুলো নটরাজন একের পর এক তুলে নিজের পকেটে রাখছে। তারপর জঙ্গলের অনেক ভিতরে হাতির বিষ্ঠার মধ্যে পলিথিনের প্যাকেট দেখিয়ে বলেছিল, যারা জঙ্গলে এসেছিল তারা খাবারের অংশসহ প্যাকেট ফেলেছিল। আর সেটা খেয়ে হাতিটি ডায়ারিয়ায় মারা গেছে। আমি আর কোনদিন জঙ্গলের নিয়ম ভঙ্গ করিনি… সেই শেখা আজও বহন করি।
লাটাগুড়ির রাস্তায় গাড়িতে বাবার সাথে চলেছি৷ হাতিকে ওরা “মহাকাল” বলে। মহাকাল যতক্ষণ রাস্তা পার হল ততক্ষণ কোনো ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে দেখিনি… সেটা কয়েক ঘন্টা হলেও। ভয়ে না ভক্তিতে তা বলতে পারি না। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝেই মহাকাল বেরিয়ে আসেন, ক্ষেতের ফসলও নষ্ট করেন। ওখানকার বাড়িগুলো কাঠের গুঁড়ির ওপর দাঁড়ানো… নীচটা পুরো ফাঁকা ওপরে ঘর… অনেকটা ট্রি হাউসের মত৷ সেই বাড়ির গুঁড়ির গায়ে দাঁতালের রাগান্বিত দন্তাঘাত দেখেছি।
এশিয়ার হাতির চারটি উপপ্রজাতির মধ্যে একটি হল ভারতীয় হাতি (Elephas maximus indicus)। যা ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামে দেখা যায়। আইইউসিএনের রেডলিস্ট অনুযায়ী, বিপন্ন প্রজাতি কারণ গত কয়েক দশকে এই প্রজাতির সংখ্যা ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বিভিন্ন কারণে।
হাতি যেহেতু বড় মাপের তৃণভোজী প্রাণী সেহেতু বনজঙ্গল ধ্বংস শুধুমাত্র তাদের বাসস্হানই নষ্ট করেনি তাদের খাদ্যাভাবও ঘটিয়েছে। বন ধ্বংসের কারণ যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব শুধুমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জলাধার, বাঁধ, খাল, জাতীয় সড়ক, রেললাইন, খনি, কল কারখানা, কাঠ পাচার অনেক বেশী পরিমাণে বন ধ্বংস করেছে। ভারতবর্ষের বহু জাতীয় সড়ক, রেললাইন গেছে যা বহু বন্যপ্রাণির মৃত্যুর কারণ বিশেষতঃ রাত্রে।
দাঁতাল হাতির চোরাশিকারের জন্য দুটো অসুবিধা তৈরি হয়েছে। এক- পুরুষ ও স্ত্রী হাতির যে অনুপাত সেটি নষ্ট হয়েছে। মাদি হাতির সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। চন্দন দস্যু বীরাপ্পনের (যিনি প্রায় এক হাজার হাতি হত্যা করেছিলেন) দৌরাত্মে ১৯৬৯-১৯৮৯ এই সময়ে পেরিয়ার জাতীয় উদ্যানে পুরুষ এবং স্ত্রী হাতির অনুপাত হয়েছিল ১:৬ ৷ দুই- অনেকদিন ধরেই দাঁতবিহীন পুরুষ হাতি অর্থাৎ “মাকনা” হাতির সংখ্যা বাড়ছে… যেটা জিনগত বৈচিত্র্যকে নষ্ট করছে।
ভারতবর্ষের বেশীরভাগ জঙ্গলের গায়েই গ্রাম দেখতে পাওয়া যায় ফলতঃ যখনই বনে খাবারের অভাব দেখা দেয় হাতিরা একা বা দলবদ্ধভাবে ক্ষেতের ফসল খেতে বেরিয়ে আসে। পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী জঙ্গলের আশেপাশে যে গ্রামগুলি আছে সেখানে প্রতিবছর ফসলের ক্ষেতে হাতি হানা দেয় বেশীরভাগই বিকেলের পরে। ওই সমস্ত এলাকায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, কুমড়ো ইত্যাদি চাষ করা হয়।
দুটো বিষয় আমাকে বড়ই অবাক করেছে এক- ওই অঞ্চলে আগে খুব আখের চাষ হত। এখন ওখানকার মানুষ আখ চাষ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে হাতির কারণে। পেট ভর্তি হয়ে গেলে অন্যান্য ফসল খাওয়া হাতি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আখ খেয়ে হাতির আশ মেটেনা খেয়েই যায়। আখের ক্ষেত তছনছ করেও ওখান থেকে নাকি হাতি বেরোতে চায় না! দুই- হাতি মিষ্টি কুমড়ো খেতে বড়ই ভালোবাসে। পাঁচ-ছয় কেজির কুমড়ো পরপর এমনভাবে খায় যেমন করে মিষ্টিপ্রিয় বাঙালি টপাটপ রসগোল্লা মুখে পোরে!
ভারতবর্ষের বহু কৃষকই ঋণ নিয়ে চাষ করেন তাই তাদের পক্ষে প্রতিবছর ফসলের ক্ষতি মেনে নেওয়া বড়ই কষ্টকর। একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে চাষ কৃষকের জীবিকা—তার আয়ের উৎস- দৈনন্দিন যাপন নির্ভর করে এর উপর। তাই তারা যেকোন ভাবেই এই হানা আটকানোর চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক। ক্ষেতের ফসল বাঁচানোর জন্য তারা বিভিন্ন ধরণের ফাঁদ, আনারস, কুমড়ো বিভিন্ন ফল ও সব্জির মধ্যে বিষ ও বৈদ্যুতিক বেড়া ব্যবহার করে থাকেন।
এছাড়া জোরালো টর্চের আলো যা প্রায় সামনের আধমাইল দেখতে সাহায্য করে। এমন টর্চও চাষীরা হাতি তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করেন। মূলতঃ খাদ্যাভাব এবং ফসল বাঁচানোর চেষ্টা এই দুইই মানুষ এবং হাতির সংঘাতের প্রধান কারণ। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতবর্ষে প্রতিবছর চারশো মানুষ ও একশো হাতি এই সংঘাতে মারা যায়। (MOEF, 2010)
সাম্প্রতিক কেরালায় যে ঘটনা ঘটে গেল তা সত্যিই বড় দুঃখজনক৷ একটি গর্ভবতী হাতি কৃষকের বিস্ফোরক দেওয়া আনারসের ফাঁদে পা দিয়ে দুসপ্তাহেরও বেশী সময় অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করে যখন মৃত্যু আসন্ন বুঝেছে তখন নদীতে মুখ ডুবিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করেছে। এ ঘটনা আমাদের সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছে, আমরা কৃষকদের দোষারোপ করেছি। কিন্তু কৃষকেরা খুনী নন তারা চেষ্টা করেন তাদের ফসল বাঁচানোর তাই আমার মনে হয় এ ক্রান্তিকাল পরস্পরকে কাদা ছোড়াছুড়ির নয়। রাষ্ট্র, পরিবেশবিদ, সমাজসেবী, কৃষক এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষ সবাইকে একযোগে অত্যন্ত সহিষ্ণুভাবে এক সমাধানসূত্রে পৌঁছাতে হবে।
হাতিদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব জোরালো। একবার জীবনে কোনো অভিজ্ঞতা হলে ওরা তা কখনই ভোলে না অর্থাৎ অতীতকে ওরা মনে রাখে। নিজেদের মধ্যে ইনফ্রাসোনিক তরঙ্গের মাধ্যমে ওরা বহুদূর থেকেও যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। একবার যদি কোনো হাতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সে এবং তার সঙ্গীরা কখনই তারের কাছাকাছি যায় না, তাতে বিদ্যুৎ না থাকলেও অর্থাৎ একটি ভয় কাজ করে। ঝাড়গ্রামের কৃষকেরা বলছিলেন, হাতি সরষে ও মুলোর ক্ষেত নষ্ট করে না। উড়িষ্যা সরকার যে জঙ্গলে হাতি আছে সেই জঙ্গলের বাইরে গভীর পরিখা খনন করেছে। যার ফলে গ্রামে হাতির হানা অনেক কমেছে।
জঙ্গল যদি হাতির জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তবে হাতির লোকালয়ে আসার প্রবণতা অনেক কমে যাবে। যে সমস্ত অরণ্যে সড়ক ও রেললাইন আছে সেখানে তো বটেই এবং যেসব গ্রামে হাতি বেশী হানা দেয় সেখানে যদি মৌমাছি পালন করা হয় তবে হাতির উপদ্রব কমবে। কারণ হাতি মৌমাছিকে ভয় পায় এবং ওদের গুঞ্জন শুনলে পথ বদলে ফেলে। ফলে আমরা দুর্ঘটনায় হাতির মৃত্যুও অনেকাংশে কমিয়ে ফেলতে পারব। তবে এ সমস্ত পদক্ষেপ আমাদের সকলের সদর্থক ভূমিকার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে।
লেখক: জীববিদ্যার শিক্ষক এবং ”শুধু সুন্দরবন চর্চা” পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, ভারত।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।