হাতির ময়নাতদন্ত: বাংলাদেশের বাস্তবতা

ভারতে মানুষের নির্যাতনে একটি হাতির মৃত্যুর খবর আজ ভাইরাল। আজ সবাই ধিক্কার দিচ্ছে কেরালাবাসীকে। কিন্তু এটা কি শুধু কেরালার বাস্তবতা? আমাদের বাংলাদেশেরও প্রতিনিয়ত ঘটছে হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্বের ঘটনা। কখনো হাতি এসে আক্রমণ করে, কখনো আক্রমণ না করলেও মানুষ আগবাড়িয়ে হামলা করে হাতির ওপর। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় হাতিকে ঘায়েল করতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে তারকাটা লাগিয়ে রাখার খবরও প্রায়ই আসে কানে।

মজার বিষয় হলো প্রথমে মানুষ হাতির আবাসস্থল ধংস করে নিজের জীবিকার উৎসে রূপ দেয় আর পরে হাতি যখন তার নিজের জায়গায় আসে তখনি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তখন আমরা গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করি লোকালয়ে হাতির আক্রমণ। অথচ সেই জায়গায় যে এ হাতি যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করছিল সেটা উঠে আসে না কোনো গণমাধ্যমে।

যদি কক্সবাজারে রহিঙ্গা শিবিরের কথা বলি, যুগযুগ ধরে সেখানে বিচরণ করে এসেছে হাতির পাল। তবে এখন সেখানে মানুষের রাজত্ব। মাঝে মাঝে হাতি ফিরে আসে তার পুরনো ঠিকানায়, এতে অনেক সময় মরে মানুষ আবার কখনো হাতিকেও প্রাণ হারাতে হয়। কখনো পত্রিকার পাতায় দেখেছেন কি মানুষের আক্রমণে হাতির মৃত্যু হয়েছে এমন খবর ফলাও করে প্রচার করতে? দেখেননি। কারণ গণমাধ্যমতো মানুষ চালায় হাতির তো আর গণমাধ্যম নেই।

এবার আসি কেরালার ঘটনায়। কেরালার হাতিটির প্রতি সবাই মায়া দেখাচ্ছেন কারণ হাতিটি গর্ভবতী ছিল। কিন্তু হাতির বাহ্যিক চিত্র দেখে তো গর্ভবতী কিনা জানার উপায় নেই। আমরা জানতে পেরেছি সেখানকার বন বিভাগ জানিয়েছে বলে। তারা আন্তরিকতার সাথে মূল ঘটনা উদঘাটন করে তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল বলেই আজ বিশ্ববাপী আলোচনার ইস্যু হয়েছে একটি হাতি। আর আমাদের দেশে হয় কি?

বন্যপ্রাণী নিয়ে সাংবাদিকতায় আমি খুব বেশি পুরোনো নয়। তবে যে কদিনের অভিজ্ঞতা আছে তা বলছে, আমাদের দেশে একটি প্রাণীর মৃত্যু হলে তাকে পুতে ফেলাটাই বড় দায়িত্ব মনে করে বন বিভাগ। ময়নাতদন্ত একেবারেই যে হয় না তা বলবো না। অনেক সময় গণমাধ্যমের চাপেও ময়নাতদন্ত করা হয়, তবে যা হয় তার অধিকাংশই যে দায়সারা সেটি বলতে বড় কোনো গবেষক হতে হবে না।

এই ধরুন যদি সাম্প্রতিক সময়ের একটি ঘটনা বলি, কক্সবাজারের একটি ডলফিনের মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যমের চাপে ময়নাতদন্ত করা হয়। কিন্তু সেই রিপোর্টের জন্য টানা এক সপ্তাহ নানা দফতরে তদবির করেও সাড়া পাইনি। পরে যে কোনো মাধ্যমে সংগ্রহ করি সেই প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদন কতটা হাস্যকর ছিল তা নাহয় নাই বললাম। এ ডলফিনের তো অন্তত ময়নাতদন্ত হয়েছিল কিন্তু এর পরে আরো প্রায় ১২টি ডলফিনের মৃত্যু হলেও ময়নাতদন্ত হয়েছে বলে জানা নেই। হালদায় ২৪টি ডলফিনের মৃত্যু হলেও ময়নাতদন্ত হয়েছে মাত্র একটির। চলতি সপ্তাহে সিলেটে নয়টি বন্যপ্রাণী হত্যা, এর আগে মাদারীপুরে বানর হত্যার ময়নাতদন্ত হয়েছে কিনা একজন বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক হিসেবে আমার জানা নেই…।

প্রশ্ন হলো ভারত যেখানে এতটা আন্তরিকতার সাথে ময়নাতদন্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যম ডেকে ময়নাতদন্ত রিপোর্টসহ মৃত্যুর কারণ জানায় আমরা সেখানে কেন এত লুকোচুরি করি? এখানেই জবাব মিলবে কেন এত বন বনানী থাকতেও প্রাকৃতিক সম্পদ ও বন্যপ্রাণী গবেষণায় আমরা এতটা পিছিয়ে।

আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশেও যদি এভাবে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হতো, তা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ করা হতো এবং গণমাধ্যম সে চিত্র তুলে ধরতো তাহলে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে আসতো। কেননা মানুষ অনেকসময়ই অজ্ঞতা বসত এসব প্রাণীর ওপর চড়াও হয়। যার পেছনের ঘটনা প্রকাশ হলে অনেক ক্ষেত্রে মিটে যেতো ভুল বুঝাবুঝি। কমে যেত দ্বন্দ্ব, রক্ষা পেতো প্রাণ-প্রকৃতি।

লেখক: বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক, বাংলাদেশ।

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।