জলবায়ু পরিবর্তনে অস্তিত্ব সংকটে বন্যহাতি

শেরপুরের বনে বন্য হাতির পাল। ছবি: শাহানুল করিম চপল

মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বন্য হাতির বিচরণক্ষেত্র। এতে কয়েক বছর ধরে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। প্রাণহানি ঘটছে হাতি ও মানুষÑ দুয়েরই। একদিকে মানুষের হস্তক্ষেপে যেমন কমছে হাতির প্রাকৃতিক আবাস ও খাদ্যব্যবস্থাপনা। অন্যদিকে সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এতে আগামীতে বাংলাদেশে বন্য হাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। কারণ দলবদ্ধ ও পরিবার নিয়ে চলাফেরা করা হাতির পালের জন্য খাদ্য ও পানির চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

প্রাণিবিদরা বলছেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী হাতি। এদের কিস্টোন স্পিসিস বা আমব্রেলা স্পিসিসও বলা হয়। অর্থাৎ একটি হাতি বনে ছাতার মতো কাজ করে। হাতি টিকে থাকলে বনও টিকে থাকবে। বন টিকে থাকার অর্থই হলো হাজারো জীববৈচিত্র্যের জীবন বেঁচে যাওয়া। কিন্তু বাসস্থান ধ্বংস, বন উজাড়, জনসংখ্যার চাপ, খাদ্য ও সংরক্ষণের অভাবে হাতি আজ বিলুপ্তির পথে। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হাতির খাদ্যচক্রে প্রভাব পড়ছে।

গবেষকরা জানান, তৃণভোজী হাতির খাবারের মধ্যে রয়েছে নতুন ঘাস, গাছের পাতা, কলাগাছ, বাঁশ, গুঁড়ি, ফলমূল, গাছের বাকল ইত্যাদি। একটি হাতি প্রতিদিন ৪৫ কেজি থেকে ১০০ কেজি উদ্ভিদজাত খাবার খায়। প্রতিদিনকার খাদ্যগ্রহণের জন্য দিনে প্রায় ৩০ মাইল পর্যন্ত বন্য পরিবেশে নিজেদের করিডোরে পরিভ্রমণ করে থাকে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাতির খাদ্য উদ্ভিদ ও গাছপালা যথাসময়ে খাবারের উপযোগী হচ্ছে না; এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাতিরা লোকালয়ে আবাদি জমির ফসল খেয়ে যাচ্ছে।

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের হাতি বিচরণ করা অঞ্চলগুলোতে দিন দিন খাদ্যের পাশাপাশি পানি সংকটও দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় ঝিরি-ঝরনা বছরের বেশিরভাগ সময় শুকিয়ে থাকছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলীয় বনাঞ্চল লাগোয়া পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, ‘হাতির বিচরণক্ষেত্র এলাকায় পানির স্বল্পতা আছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। এর কারণ বনাঞ্চলের গুণগতমান হ্রাস পাচ্ছে। এতে বর্ষাকালে বনে পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এ ছাড়া আমাদের অঞ্চলে অসময়ে বৃষ্টিপাত হওয়া, বৃষ্টির পরিমাণ হ্রাস এবং ঋতুগত পরিবর্তনও হয়েছে; যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যেহেতু পানির সংকট দেখা দিচ্ছে বনে; তাই এখন হাতি লোকালয়ে মাছের ঘেরে, বাড়ির পুকুরে চলে আসছে।’ তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাতির ওপর কী প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজন। এ বিষয়ে এখনও কোনো গবেষণা হয়নি। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরা জরুরি।’

শেরপুরের বনে বন্যহাতির পাল। ছবি: শাহানুল করিম চপল

সম্প্রতি বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের হাতি চলাচলের এলাকাগুলোতে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, নদীগুলোর উজানে বাঁধ তৈরি, নদীর পাদদেশে কৃষিকাজ ও সেচের জন্য অগভীর পাম্প স্থাপনের কারণে হাতির আবাসস্থলজুড়ে বেশিরভাগ মৌসুমি স্রোত শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের হাতিরা পানির সংকটে পড়তে পারে। ‘প্রিডিকটিং রেঞ্জ শিফটস অব এশিয়ান এলিফ্যান্টস আন্ডার গ্লোবাল চেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণাটি জার্নাল ডাইভারসিটি অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনে প্রকাশিত হয়। স্পেন, জার্মানি, ভারত, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, নেপাল, ইতালি ও মিয়ানমারের বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল গবেষণাটি পরিচালনা করেন।

গবেষণায় বলা হয়েছে, আবাসস্থলের ক্ষতি ও খাদ্য সংকটের লড়াই করার পাশাপাশি এশিয়ার হাতিরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতেও পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আগামী কয়েক দশকে বিপন্ন এশীয় হাতিদের আবাসস্থল আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এশীয় হাতির আবাসস্থল হিমালয়ের উচ্চতায় স্থানান্তরিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

জলবায়ু ও প্রাণ-প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শেরপুর অঞ্চলে প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড়ের ফলে শুধু বিচরণক্ষেত্রই নয়, হাতির খাদ্যেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ুগত সংকটের কারণে তাপমাত্রায় পরিবর্তন আসায় হাতি যেসব গাছ খেতে পারে, সেসব গাছ কমে গেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বনভূমিতে এখন কাস্ট্রোল-জাতীয় গাছ বেশি, কমে গেছে গুল্মজাতীয় গাছ। এজন্য একটা হাতির দেড়শ কেজি খাবার ও ৬০ থেকে ১০০ লিটার পানি সংগ্রহ করা অনেক কঠিন। এসব কারণে আমরা দেখছি আগের চেয়ে এখনকার হাতি মন্হরগতির; এ ছাড়া তাদের আকৃতিগত পরিবর্তনও এসেছে, দিন দিন এ দেশের হাতি খর্বাকায় ও রুগ্‌ণ হয়ে যাচ্ছে।’

বুয়েটের জলবায়ু গবেষক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আগামীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দশমিক ৫ মিটার থেকে দশমিক ৮ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ততা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে বেড়েছে। যার প্রভাব মানুষের পাশাপাশি হাতিসহ ছোট-বড় বন্য প্রাণীর ওপরও পড়ছে।

বন্য হাতিসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৬ সালের সবশেষ জরিপ অনুয়ায়ী এ দেশে বন্য পরিবেশে ২৬৮টি হাতি আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে ৫০টির বেশি হাতি মারা গেছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণকর্মীদের দাবি, গত সাত বছরে মারা গেছে অন্তত ৭৬টির বেশি হাতি। যার ৯০ শতাংশকেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।