আদিগন্ত নোনা জলরাশির বুকে আকাশ যেখানে মিতালি করেছে সমুদ্রের সীমানায়, নীল আকাশের বুঝি শেষ ঐ বনের কিনারায়, সেখানে কাদামাটির পললে গড়ে ওঠা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যপুরীর নাম `চর কুকরি-মুকরি’। বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ-জেলা ভোলার সাতটি উপজেলার মধ্যে সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে উপজেলার নাম চরফ্যাশন। এই চরফ্যাশন উপজেলার সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ‘চর কুকরি-মুকরি’।
স্বল্প সংখ্যক জনবসতির এ দ্বীপটি দুর্গম ও যোগাযোগ সময় স্বাপেক্ষ। প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার বা চার হাজার একর আয়তনের নোনাপানির কাদাজলে গড়া চরের কঠিন জীবন-যাপনের চ্যালেঞ্জ ও অপ্রতুল সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও বনকর্মীদের নিরলস পরিশ্রমে গড়ে ওঠেছে আজকের এ নয়নাভিরাম, মনমাতানো সৌন্দর্যের ম্যানগ্রোভ বন।
বিস্তৃর্ণ জলরাশির মাঝে কাদামাটির এই বনের পূর্ব সীমানায় প্রমত্তা মেঘনার মোহনা, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে বুড়া-গৌরাঙ্গ, পশ্চিমে তেতুলিয়া নদী এবং সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। জোয়ার-ভাটার প্লাবন বিধৌত এই চরের বনটি তাই অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ম্যানগ্রোভ বা নোনাজলের বন।
চর কুকরি-মুকরি বনটি একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আঁধার। কেওড়া, ছৈলা, বাইন, গরান, পশুর, কাকড়া, হেতাল, গেওয়া, গোলপাতা, বলা, হারগাজা, সুন্দরী, মেহগনি, আমুরসহ হরেক রকমের উদ্ভিদের মহাসমারোহে। যোগ হয়েছে বিচিত্র প্রজাতির হাজার হাজার পাখি, হরিণ, বানর, শিয়াল, অজগর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, উদবিড়াল, শুশুক ইত্যাদি। শীতে এখানে পরিযায়ী পাখির আগমনে মহাউৎসবে রূপান্তরিত হয়। এখনো আছে কিছু কিছু পরিযায়ী পাখিরা।
চরের থকথকে নোনা কাঁদায় গড়ে তোলা মনুষ্যসৃজিত এ বন এখন এক সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম। সৃজিত বাগান এখন নানান বন্য উদ্ভিদ-প্রাণীর সমাগমে কানায় কানায় পূর্ণতা লাভ করেছে, যা রূপ পরিগ্রহ করেছে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ গহীন বনের। বনের গহীনে ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের সারি, ছায়া সুনিবিড় নির্জনতা, গাঁ ছমছম পরিবেশ যেন নিমিষেই নিয়ে যায় স্বপ্ন বিভোর এক কল্পনার জগতে।
জীববৈচিত্র্যের স্বর্গ এ বনের অন্যতম আকর্ষন হলো হাজার হাজর পাখি। বিচিত্র প্রজাতির পাখিদের স্বাধীন ও নির্বঘ্ন, নিরুপদ্রব চলাচল ও বসতি দেখে মন ও চোখ জুড়ায়। গোধূলি লগ্নে পাখিদের ঘরে ফেরার যেন কোন তাড়নাই নেই এখানে। ভোর-সকালে পাখিদের কলতান যেন মাতমে রুপান্তরিত হয়ে ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দ্বীপ ও বনাঞ্চল জুড়ে, সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য, মায়াবী ও মনোহারী রুপ।
পাখিদের স্বাধীন বিচরণ, তারস্বরে কলতান, বনের নৈসর্গিকতা, বিস্তর্ণ জলরাশির অনাবিল মায়াবী সৌন্দর্য, নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতা, বাতাসের বহুমাত্রিক গতিবেগসহ এ স্বপ্নপুরির মুগ্ধতা যখন কানায় কানায়, তারসাথে যোগ হয়েছে এখানকার আতিথিয়েতা ও সকলের আন্তরিকতা। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে উপভোগ করলাম কুকরি-মুকরির অনাবিল সৌন্দর্যে।
কুকরি-মুকরির আরেকটি আকর্ষণ হলো বনবিভাগের সর্ববৃহৎ রেষ্টহাউজ। আধুনিক সব সুবিধা সমৃদ্ধ ’কোষ্টাল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ নামক এই মেগা স্থাপনায় আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১৬টি স্যুট ও কক্ষ, সুবিশাল ডাইনিং হল, প্রসস্থ বসার রুম, কনফারেন্স সেন্টার, প্রশিক্ষণ কক্ষ, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, হেলিপোর্ট ও খোলার মাঠের ওপারে সবুজ বনের নি:সংকোচ হৃদয়হারা নৈবেদ্য।
২০১৭ সালে নির্মিত এই অনবদ্য সৌন্দর্যপুরীর নৈসর্গিকতা উপভোগ করতে এসেছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। ২৪ ও ২৫ জানুয়ারী ২০১৮ মহামান্য রাষ্ট্রপতি সপরিবারে এখানে রাত্রি যাপন করেন, উপভোগ করেন সাগরের সন্ধিস্থলে বনবিভাগের সৃষ্ট এ নয়নাভিরাম নান্দনিকতা।
লেখক: বন সংরক্ষক, বাংলাদেশ বনবিভাগ।