টিনে উধাও পাহাড়ি ছন!

বাংলাদেশের পাবর্ত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে একটি ছনের বাড়ি। ছবি: কমল দাশ, আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ

এক সময় সবুজ পাহাড়ের উঁচু টিলায় কোন পাড়ার দিকে তাকালেই দেখা মিলতো ধূসর রঙের ছনে ছাউনী দেয়া বাড়ি-ঘর। শীত বা গরম যেকোন মৌসুমেই আরামদায়ক সেই ঘর। তাই পাহাড়ি জনপদে ছনের ঘরই ছিল জনপ্রিয়। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে বাংলাদেশের পাহাড়ে এখন দেখা মেলে না ছনের ছাউনী বাড়ি। উৎপাদন ও বেচা-বিক্রি তাই মন্দা ছনেরও। কারণ কী?

কথা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার কয়েকজন বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাদের মতে, ঢেউটিনের টেকসইকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এক সময়ের ছন ব্যবহারকারীরা। এর নেপথ্যে রয়েছে, আর্থিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতিও। কারণ ছন উৎপাদন ও ব্যবহারে বেড়েছে ব্যয়। কারণ ছনের ঘরের ছাউনী প্রতি বছর পরিবর্তন করতে হয়।

রাঙামাটির কাউখালীর কলমপতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যজাই মারমার বলেন, “যাদের সামর্থ আছে তারা ঢেউটিন ব্যবহার করছেন। আর সেইসঙ্গে পাহাড়ে ছনের উৎপাদনও কমে গেছে, তাই এখন ছনের ঘর দেখা যায় না। তবে অস্বচ্ছল জনগোষ্ঠীদের এখনো ভরসা ছনেই।”

পাবর্ত চট্টগ্রামের পাহাড়ি পাড়াগুলোর ঘর-বাড়িতে ছনের বদলে এখন ঢেউটিনের আধিক্য। ছবি: কমল দাশ

বিশ্লেষকদের মতে, সহজ ও আরামদায়ক হলেও প্রাকৃতিক এই ছাউনী ব্যবহারে মানুষের অনীহার কারণ- রুচিগত পরিবর্তন। “প্রাকৃতিকভাবে খুবই উপকারী ছন। বিশেষ করে গরমকালে ঠান্ডা রাখে আর শীতে গরম রাখে ঘর,” মন্তব্য করেন পরিবেশবিদ শাওন ফরিদ। “টিন বা ইট-পাথরের চালায় রৌদের তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠে ঘর, কিন্তু ছনের ক্ষেত্রে সেই উত্তাপ অনেকাংশে কম অনুভব হয়,” যোগ করেন তিনি।

পরিবেশবিদদের মতে, টিনের ব্যবহার পাহাড়ি জনপদের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ দেশে উৎপাদিত বেশিরভাগ টিনই পরিবেশ বান্ধব নয়।

“বেশিরভাগ মানুষ বাড়ির ছাদে এখন ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করেন ছন। আর যারা আগে ছন চাষ করতো তারা এখন পাহাড়ে বিভিন্ন ফল ফলাদির চাষ বা বাগানে নিয়োজিত হয়েছেন,” মন্তব্য শাওন ফরিদের।

রাঙ্গামাটিতে ছন-ক্রেতা মো. শাহজাহান বলেন, ছন কেনা ও চালা মেরামতে শ্রমিক খরচে যে অর্থ ব্যয় হয়, ওই টাকা দুই বছর জমাইলে ঢেউটিন লাগানো যায়। যা অনেকদিন টিকে থাকে।

বিক্রির জন্য রাখা ছন। ছবি: প্রতিনিধি

অন্যদিকে চাষিরা বলছেন, আগের মতো চাহিদা না থাকায় দামও মিলছে না ছনের। ফলে অন্য কাজে শ্রম দিলে দৈনিক তিনশো টাকা আয় হয়।

নাইল্যাছড়িতে ছন বিক্রেতা আব্দুল জলিল বলেন, নিজের বাগানে চাষ করলে দিনে একজন শ্রমিক ছয় বোঝা ছন কাটতে পারে। কিন্তু বয়ে আনার কষ্ট ও সময়-সাপেক্ষ কাজ এটি।  

রাঙামাটি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আপ্রু মারমা বলেন, আর্থিক লাভবান না হওয়াতে ছন চাষ না করে বাগান সৃজনের কাজে ছুটছেন অনেকেই।” তবে ছনের বিকল্প ব্যবহার বাড়ানো হলে হয়তো এ পরিস্থিতি পরিবর্তন সম্ভব, যোগ করেন তিনি।

ছন চাষ ও আহরণ পদ্ধতি:

অনাবৃত শুষ্ক পাহাড়ি এলাকায় বেশ ভালো জন্মে ছন। ফলজ ও বনজ গাছের পাশাপাশি হয় ছনও। আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা যায়, চাষাবাদে নেই তেমন পরিশ্রম। শুধু পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষ করা হবে তা পরিস্কার করে দিলেই কিছুদিন পর প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় ছনের কুঁড়ি।

দৈর্ঘ্য দেড় দুই হাত হলে আগাছা পরিস্কার করে সার দিলে ৬-৭ ফুট লম্বা হলেই কাটার উপযুক্ত হয়। আহরণের পর পর্যাপ্ত রোদে ১৫ থেকে ২৫ দিন শুকিয়ে নিলে এরপরই তা ব্যবহার উপযোগী হয় প্রাকৃতিক এই ছাউনি।